West Bengal Flood

সদিচ্ছার খরা

দামোদরের বন্যাকে রাজনৈতিক বিরোধিতা দিয়ে ব্যাখ্যা করা অতি-সরলীকরণ। এক দিকে জলাধার, নদী-নালার জলধারণ ক্ষমতার হ্রাস পাচ্ছে, অন্য দিকে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য অল্প সময়ে বিপুল বর্ষণ প্রায় অবধারিত হয়ে উঠছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৭:৩৫
Share:

দামোদর ও তার শাখা নদীগুলির বন্যায় দক্ষিণবঙ্গে যে মারাত্মক বিপর্যয় হল এ বছর, তার কারণ নিয়ে আলোচনা কম হয়নি। কিন্তু প্রতিকার কী, তার দিশা দেখা যাচ্ছে না। বাঁধ-সংলগ্ন জলাধার থেকে জল ছাড়লে বন্যা হবে। জল ছাড়া না হলে বাঁধ ভেঙে আরও বড় বিপত্তি হবে। বন্যার অন্যতম কারণ অবশ্যই জলাধার এবং নদীখাতে পলি জমে ওঠা। পলি সরানো বা ‘ড্রেজিং’ না হওয়ায় জলধারণ ক্ষমতা হারাচ্ছে জলাধারগুলি। কিন্তু ড্রেজিং করে জলধারণের ক্ষমতা বাড়ানো কি আদৌ সম্ভব? ২০১৩ সালে কেন্দ্রীয় পরিবেশ, বন এবং জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রক-গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি ডিভিসির মাইথন এবং পাঞ্চেত জলাধার সংস্কার বিষয়টি খতিয়ে দেখেছিল। কমিটির মতে, প্রত্যাশিত হারের চাইতে দ্রুত পলি জমছে— পাঞ্চেতে ছ’গুণ এবং মাইথনে ন’গুণ বেশি। সংস্কার না হলে এক দশকের মধ্যে এই দুটো জলাধার জলধারণের ক্ষমতা অর্ধেক থেকে দুই-তৃতীয়াংশ হারাবে, তাই বন্যা প্রতিরোধে ব্যর্থ হবে। ২০২১ এবং ২০২৪ সালের ভয়াবহ বন্যা দেখিয়ে দিল, এই মূল্যায়ন কতখানি সত্য। কমিটি এ-ও বলেছিল যে, পলিমুক্তির কাজে খরচ হবে অন্তত সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। কিন্তু খরচই এক মাত্র সমস্যা নয়। বাঁধ-সংলগ্ন জলাধার থেকে পলি তুলতে গেলে বর্ষার আগে জলাধার শূন্য করতে হবে। তাতে পানীয় জলের অভাব দেখা দেবে। সেই সঙ্গে, যে-হেতু ফের পূর্বের স্তরে জল জমাতে অনেক সময় লাগবে, তাই বেশ কিছু দিন সেচের জলের অভাবও দেখা দেবে। বিশ্বের অধিকাংশ বাঁধ এই জন্য পলিমুক্ত করা হয় না।

Advertisement

ভারতেও কেন্দ্রীয় সরকার দামোদরের পলিমুক্তির নীতি গ্রহণ করেনি, এবং তা জানিয়েও দিয়েছে। তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় সংসদে প্রশ্ন করেছিলেন (৩১ মার্চ, ২০২২), ডিভিসি-র বাঁধগুলিকে পলিমুক্ত করার জন্য কেন্দ্র একশো ত্রিশ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে কি না, এবং করে থাকলে জলধারণের ক্ষমতা কতটা বেড়েছে? উত্তরে কেন্দ্র জানিয়ে দেয়, ওই খাতে কোনও টাকাই বরাদ্দ করা হয়নি। ২০১২ সালে ডিভিসি পাঞ্চেত জলাধারের সংস্কারের প্রস্তাব পেশ করলেও পরে তা বাতিল করেছে। কারণ দু’টি— বার বার বিপুল খরচ, এবং বিপুল পরিমাণ পলি কোথায় ফেলা হবে, তা নির্ধারণে সমস্যা। অর্থাৎ ২০২৪ সালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ড্রেজিং না করার জন্য কেন্দ্রকে দুষলেও, অন্তত দু’বছর আগে কেন্দ্র এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিল। অপর দিকে, বিশ্ব ব্যাঙ্কের সহায়তায় পশ্চিমবঙ্গে যে বৃহৎ সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প শুরু হয়েছে প্রায় এক দশক আগে, তার অন্যতম লক্ষ্য ছিল নদী-নালা সংস্কারের মাধ্যমে নিম্ন দামোদর উপত্যকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ। এ বছরও অর্থ প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বাজেট-বক্তৃতায় অনেক সাফল্যের কথা বললেন, জানালেন যে এ পর্যন্ত ২২৯৫ কোটি টাকা খরচ করে তেতাল্লিশটি নদী ও সেচ নালা পলিমুক্ত করা হয়েছে যার মোট দৈর্ঘ্য ১০৮ কিলোমিটার। ৬৪০ কিলোমিটার সেচ নালার উন্নতি হয়েছে। এ সবের পরিপ্রেক্ষিতে, বন্যা-বিধ্বস্ত দক্ষিণবঙ্গে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন ওঠে, এই প্রকল্পে বাস্তবিক কাজ কতটুকু হয়েছে? এর কী সুবিধা পেয়েছে রাজ্যবাসী?

দামোদরের বন্যাকে রাজনৈতিক বিরোধিতা দিয়ে ব্যাখ্যা করা অতি-সরলীকরণ। এই সঙ্কট জটিল ও বহুমাত্রিক। এক দিকে জলাধার, নদী-নালার জলধারণ ক্ষমতার হ্রাস পাচ্ছে, অন্য দিকে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য অল্প সময়ে বিপুল বর্ষণ প্রায় অবধারিত হয়ে উঠছে। এ দুইয়ের ফলে বন্যা আগের চেয়েও বিধ্বংসী হয়ে উঠছে। পাশাপাশি রয়েছে বর্ষার বিলম্বের জন্য সেচের কাজে ভূগর্ভের জলের অতিরিক্ত ব্যবহার, পুকুর সংস্কারের জন্য বরাদ্দ বন্ধ, অবৈধ নির্মাণের জন্য নদী-নালার বিপন্নতা। এই পরিস্থিতিতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও জলের সংরক্ষণের জন্য কেন্দ্র-রাজ্যের যে সুসংহত উদ্যোগের প্রয়োজন, তার জন্য চাই রাজনৈতিক সদিচ্ছা। ওই বস্তুটির খরা চলছে দীর্ঘ দিন।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement