—প্রতীকী ছবি।
কেবল সংখ্যায় নয়, রাজনৈতিক বহুত্বের মাত্রাতেও ভারতের সাধারণ নির্বাচন গোটা দুনিয়ায় অ-তুলনীয়। দুনিয়ার বৃহত্তম গণতান্ত্রিক আইনসভায় জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য দেড় মাসে সাতটি পর্বে বিন্যস্ত প্রায় একশো কোটি নাগরিকের ভোট গ্রহণের এই আয়োজনের মাত্রাটি আক্ষরিক অর্থেই অনন্য। কেন্দ্রীয় সরকারের বর্তমান শাসকরা নিশ্চয়ই এই সুযোগে আরও এক বার ‘বিশ্বগুরু’র ধ্বজা তুলে আপন মহিমা প্রচারে ব্যস্ত হবেন। বলা বাহুল্য, সেই আত্মপ্রচার নিতান্তই নাবালকোচিত, কারণ ১৯৫২ সাল থেকেই নির্বাচনী গণতন্ত্রের মাপকাঠিতে বিশ্বসভায় ভারতের স্থান এক নম্বর আসনে স্বীকৃত হয়ে এসেছে, অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচন সেই ধারারই অনুসারী। কিন্তু এমন একটি আয়োজন তার নিজগুণেই অকুণ্ঠ অভিবাদনের যোগ্য। নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে দেশের বহুধাবিস্তৃত প্রশাসনের কর্তা ও কর্মীরা নিয়মিত এই গণতান্ত্রিক উৎসবের অবয়বকে গড়ে তোলেন, অগণন ভারতবাসীর সাগ্রহ যোগদানের ফলে সেই অবয়বে প্রাণপ্রতিষ্ঠা হয়। বহু দোষত্রুটি এবং অনাচারের কথা মনে রেখেও নির্দ্বিধায় বলা দরকার যে, গণতন্ত্রের পক্ষে এই কৃতিত্বের মূল্য অপরিসীম।
ঠিক সেই কারণেই নির্বাচন যাতে নাগরিকদের অবাধ মতদানের প্রক্রিয়া হয়ে উঠতে পারে, তা নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক। নির্বাচন কমিশন ভোটের নির্ঘণ্ট ও আচরণবিধি ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে, বরাবরের মতোই, এই প্রশ্নটিতে প্রত্যাশিত গুরুত্ব দিয়েছে। নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্যে বিশেষ জোর পেয়েছে সন্ত্রাসমুক্ত ভোটের কথাটি। দুর্ভাগ্যের কথা, নির্বাচনের প্রচার এবং ভোটগ্রহণের দিনগুলিতে, এমনকি তার পরবর্তী অধ্যায়েও এ দেশে জবরদস্তি, হিংসা ও সন্ত্রাসের প্রাদুর্ভাব আজও বহাল। এবং, পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যটি সেই উপদ্রবের অন্যতম প্রধান ভরকেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই রাজ্যের মতো প্রত্যক্ষ নির্বাচনী হিংসার প্রকোপ এখন ভারতের অন্য রাজ্যগুলিতে বিরল। ভৌগোলিক আয়তনের বিচারে পশ্চিমবঙ্গ ‘বড় রাজ্য’ নয়, অথচ এখানে ভোট নেওয়ার জন্য সর্বাধিক সাত দিনের নির্ঘণ্টই অনুসরণ করা হবে— নির্বাচন কমিশনের এই সিদ্ধান্ত কতটা যুক্তিযুক্ত আর কতখানি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, তা নিয়ে তর্ক চলতে পারে, কিন্তু আয়তনের তুলনায় যে এই রাজ্যের ভোটে অনেক বেশি নিরাপত্তা রক্ষী ও আনুষঙ্গিক পরিকাঠামোর প্রয়োজন হয়, সেই সত্য তর্কাতীত।
কিন্তু প্রত্যক্ষ হিংসাই গণতান্ত্রিক নির্বাচনের একমাত্র ব্যাধি নয়। সুস্থ আলোচনা, বিতর্ক এবং প্রচারকে মিথ্যার বেসাতি, কদর্য অপপ্রচার ও ব্যক্তিগত আক্রমণ এবং বিষাক্ত সাম্প্রদায়িক ও অন্যবিধ বিদ্বেষের নিরন্তর আক্রমণে বিপর্যস্ত ও বিধ্বস্ত করার অজস্র নজির এ দেশের ভোটপর্বে তৈরি হয়ে চলে। গভীরতম উদ্বেগের কারণ এই যে, সেই অন্যায় প্রতিরোধের বদলে শাসকেরা অনেক ক্ষেত্রেই তাকে সরাসরি অথবা প্রকারান্তরে প্রশ্রয় দেন। প্রচারের ভাষায় হিংস্রতা, বিদ্বেষ, মিথ্যাভাষণ ইত্যাদি অন্যায় দমনের জন্য আইন আছে, নির্বাচনী কমিশন এই বিষয়ে যথাবিহিত নির্দেশিকাও প্রচার করে থাকে, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যায়, শাসক শিবিরের লোকেরা— কেবল নেতারা নন, নানা মাপের স্থানীয় প্রভাবশালীরাও— সেই সব নির্দেশিকার তোয়াক্কা না করেও দিব্য পার পেয়ে যান। তার পাশাপাশি কাজ করে অর্থবলের বিপুল প্রভাব, যার মাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে চলেছে, নির্বাচনী বন্ডের সাম্প্রতিক কাহিনি যার একটি নিতান্তই খণ্ডিত পরিচয় দেয় এবং একই সঙ্গে প্রশ্ন তোলে: রক্ষকই কি তবে ভক্ষক? এই প্রশ্নই ওঠে নির্বাচন কমিশনের গঠন-প্রক্রিয়া নিয়েও। সুতরাং, ভোটদানের কর্মকাণ্ডটি আড়ে ও বহরে অতিকায় এবং আপাতদৃষ্টিতে চলমান হলেও তার অন্দরমহলে এবং অন্তরালে ভারতীয় গণতন্ত্র কতখানি সুস্থ ও স্বাস্থ্যবান, সেই সংশয় থেকেই যায়।