—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
নতুন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রতিমন্ত্রী হিসাবে স্থান পেয়েছেন দু’জন। জাহাজ মন্ত্রকে শান্তনু ঠাকুর এবং শিক্ষা ও উত্তর-পূর্ব উন্নয়নের দুই মন্ত্রকে সুকান্ত মজুমদার। নরেন্দ্র মোদীর সরকারে এ-রাজ্যের কোনও পূর্ণমন্ত্রী নেই। এই (অ)প্রাপ্তি নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের শিবির থেকে তিক্ত ব্যঙ্গোক্তি শোনা গিয়েছে, বিজেপির মন্ত্রী বা মুখপাত্ররা প্রত্যুক্তি হিসেবে তিক্ততর বিদ্রুপ ছুড়ে দিতেও কালক্ষেপ করেননি। এ-রাজ্যের রাজনৈতিক সওয়াল-জবাব ইদানীং যে অরুচিকর স্তরে আবর্তিত হয়, এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু সেই আবর্জনা সরিয়ে রেখে একটি বৃহত্তর প্রশ্ন তোলা অত্যন্ত জরুরি। তৃতীয় দফার এনডিএ জমানায় কেন্দ্রীয় সরকার থেকে পশ্চিমবঙ্গের প্রাপ্তির সম্ভাবনা কতখানি? অন্য ভাবে বললে, পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক ও সামাজিক উন্নয়নে কেন্দ্রের ভূমিকা কেমন হবে বলে রাজ্যবাসী আশা বা আশঙ্কা করতে পারেন? দলীয় রাজনীতির লাভ-লোকসানের হিসাবনিকাশ এবং রণকৌশলের পরিকল্পনা চলতেই থাকবে, কিন্তু তার পাশাপাশি রাজ্যের মানুষের ভাল-মন্দের অঙ্কটাও কষা দরকার বইকি।
প্রথমেই মনে রাখা দরকার, মন্ত্রিসভায় একটি রাজ্যের কত জন প্রতিনিধি স্থান পেলেন বা কত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রক তাঁদের দেওয়া হল, তার সঙ্গে সেই রাজ্যের উন্নয়নে কেন্দ্রীয় সাহায্য বা সহযোগিতার কোনও অবধারিত সম্পর্ক নেই। পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাস তার সাক্ষী। কোনও মন্ত্রী রাজ্যের বা তার বিশেষ বিশেষ অঞ্চলের স্বার্থের প্রতি বিশেষ মনোযোগ করেছেন, কেউ বা কেন্দ্রীয় সরকারে রীতিমতো উচ্চস্তরে বিরাজমান হয়েও পশ্চিমবঙ্গের দিকে ফিরে তাকাননি। কিন্তু একই সঙ্গে এ-কথাও অনস্বীকার্য যে, বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্যের কেন্দ্রীয় সরকারের দৃষ্টি ও সহযোগিতা আকর্ষণের জন্য মন্ত্রিসভায় দর কষাকষির একটি বাড়তি গুরুত্ব থাকবে। জোট সরকার এ-বার প্রকৃতপক্ষেই জোট সরকার। প্রধানমন্ত্রী তথা তাঁর দলের গদি সুস্থিত রাখার জন্য একাধিক শরিক দলের চাহিদা পূরণের চাপ থাকবেই। বিশেষ বর্গের রাজ্য হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়াই হোক, রাজ্যের নতুন রাজধানীর পরিকাঠামো নির্মাণই হোক, এই চাহিদাগুলি পূরণের জন্য কেন্দ্রীয় কোষাগার থেকে বিপুল অর্থ বরাদ্দ করতে হবে। সমস্ত গুরুভার মন্ত্রক নিজেদের হাতে রাখার দুর্মর আধিপত্যবাদী মানসিকতার কারণে প্রধানমন্ত্রীর খরচ আরও বাড়তে বাধ্য। আবার একটি বা দু’টি রাজ্যকে বিশেষ সুবিধা দিতে হলে অন্য নানা রাজ্য থেকেও চাপ বাড়বে, বিশেষত যখন একাধিক গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন আসন্ন বা অদূরবর্তী এবং সেখানে বিজেপির পথ কণ্টকাকীর্ণ, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। এই টানাপড়েনের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের জন্য বিশেষ বরাদ্দ বা সাহায্য দূরস্থান, কেন্দ্রের ঔদাসীন্য বা বঞ্চনা আরও বাড়বে কি না, সেই প্রশ্ন একেবারেই অসঙ্গত নয়।
রাজ্যের শাসক দল তথা তার নেত্রীর মানসিকতা ও আচরণ এই প্রশ্নটিকে আরও জোরদার করে তোলে। পশ্চিমবঙ্গের প্রতি কেন্দ্রের বঞ্চনা বা অন্যায়ের যে অভিযোগ তাঁরা করে আসছেন, তা একেবারেই মিথ্যা নয়। এই বৈষম্যের ইতিহাসও দীর্ঘ, কেন্দ্রের ‘বিমাতৃসুলভ’ আচরণের অভিযোগ এক কালে রাজ্যের বাতাসকে সর্বক্ষণ মুখরিত করে রাখত। কিন্তু গত এক দশকে সেই ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় প্রবর্তিত হয়েছে। কেন্দ্রের বঞ্চনার অভিযোগ এবং তার জবাবে রাজ্যের দুর্নীতি ও অপদার্থতার প্রতি-অভিযোগ কেবল সওয়াল-জবাবে সীমিত থাকেনি। এক দিকে কেন্দ্র বিভিন্ন প্রকল্পের টাকা আটকে রেখেছে, অন্য দিকে রাজ্য বিভিন্ন কেন্দ্রীয় প্রকল্প সরাসরি বা কার্যত ‘বয়কট’ করে চলেছে। এই দ্বৈরথ থেকে দুই পক্ষই জনসমর্থনের ফসল কুড়োতে তৎপর, কিন্তু মার খেয়েছে রাজ্য। এই প্রেক্ষাপটেই নতুন কেন্দ্রীয় সরকার, তার নতুন বাধ্যবাধকতা, সেই সরকারে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষীণ উপস্থিতির গুরুত্ব অনেকখানি। দুশ্চিন্তা তাই অনিবার্য।