TMC

অতঃ কিম্

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একক নেতৃত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত তৃণমূল কংগ্রেস দলে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র অভিষেক ক্ষমতার অন্যতম ভরকেন্দ্র হয়ে উঠেছিলেন গত পাঁচ বছরে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৬:৪৮
Share:

সহসা পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলটি যে পথে এগিয়ে চলছিল, তা যেন একটি বাঁক নিয়েছে। রাজ্যের রাজনীতি এবং প্রশাসনের উপরে সেই বাঁকের ছায়াপাত অনিবার্য। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একক নেতৃত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত তৃণমূল কংগ্রেস দলে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র অভিষেক ক্ষমতার অন্যতম ভরকেন্দ্র হয়ে উঠেছিলেন গত পাঁচ বছরে। দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পরে তাঁর কর্তৃত্বে সিলমোহরও পড়েছে। আর এই সবই সম্ভব হয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চেয়েছেন বলে। অতএব পিসির গড়া তৃণমূল কংগ্রেসের উত্তরাধিকার যে ভাইপোর উপরেই বর্তাবে, তাতে কারও সংশয় ছিল না। স্বয়ং মমতা সম্প্রতি সেই ভাবনায় ঝড়ের হাওয়া বইয়ে দিয়েছেন। বিধানসভার শীত অধিবেশনে তৃণমূল পরিষদীয় দলের বৈঠকে বিধায়কদের কাছে প্রাঞ্জল ভাষায় দলনেত্রীর বার্তা, তিনিই সব দেখবেন। সম্ভবত এর কারণ, একনেত্রী-কেন্দ্রিক দলটিতে উপধারা বেগবান হয়ে এক দিকে দেখা গিয়েছে নবীন-প্রবীণ ভেদরেখা, অন্য দিকে চালু হয়েছে ‘কর্পোরেট’ সংস্কৃতি। পেশাদার সংস্থাকে দিয়ে ভোট-কুশলীর কাজ ছাড়াও প্রার্থী-সন্ধান ও নেতা-মন্ত্রীদের কাজের ‘মূল্যায়ন’ এই প্রয়াসের উল্লেখযোগ্য দিক। মমতা গোড়ায় রাশ টানেননি, বা টানতে চাননি, যদিও প্রবীণদের কার্যত অপ্রাসঙ্গিক করে ফেলা নেত্রীর ইচ্ছার পরিপন্থী। অনেকের ধারণা, দলের তহবিল, খরচ ইত্যাদিও উভয়ের মধ্যে সমস্যার কারণ। দলনেত্রীর ‘ব্লক পর্যন্ত সব’ নিজে দেখার ব্যাখ্যা এ ভাবেও করা হচ্ছে।

Advertisement

প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কি ইতিপূর্বে তাঁর দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের ‘ক্ষমতা’ তথা অধিকারের সীমা নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন? সম্ভবত নয়। ক্ষমতার এমন উচ্চতা রাতারাতি তৈরি হয় না। সুতরাং আজকের বাস্তব কোন পথে তৈরি হল, নেত্রী তার কিছুই জানেন না, তা অসম্ভব। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যে বিজেপির অগ্রগতির পরে তৃণমূলকে সংগঠিত করার এবং পেশাদারি কৌশলে মাঠে নামানোর ক্ষেত্রে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা প্রশংসিত হয়েছিল। ২০২১-এর বিধানসভা এবং ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে তৃণমূলের সাফল্যের পিছনেও অভিষেকের ‘কৃতিত্ব’কে তৃণমূল নেত্রী স্বীকৃতি দিয়েছেন। প্রশাসন ও পুলিশের মধ্যে তাঁর ‘প্রভাব’ আলোচনার পরিসরে এসেছে, যার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পুষ্ট হয়েছে তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষাও। এই দলীয় ‘সঙ্কট’-এর দায় তাই দলনেত্রীরও। প্রসঙ্গত, যে দিকেই ঘটনা এগোক না কেন, কোনও রাজনৈতিক দলে নতুন প্রজন্মের এগিয়ে আসার রাস্তা সঙ্কুচিত হয়ে গেলে তা শুভসংবাদ হতে পারে না।

রাজনীতি সর্বদাই সম্ভাবনার শিল্প, অনিশ্চয়তারও। আজকের পরিস্থিতি কাল বদলে যাওয়া সময়ের অপেক্ষা। তবু এক-এক বাস্তবতা থেকে তাৎক্ষণিক ভাবে বিবিধ ধারণার জন্ম হয়। অনুমানের অবকাশও তাতে বাড়ে। সেই সূত্রেই প্রশ্ন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে দলের (এবং সরকারের) সমগ্র রাশ নেওয়ার আসল অর্থ কী? তৃণমূল কংগ্রেস প্রকৃতপক্ষেই ব্যক্তিনির্ভর দল— আরও নির্দিষ্ট ভাবে বললে, মমতা-নির্ভর। দলের ভোট-লক্ষ্মী তিনি, সুতরাং পোশাকি সংজ্ঞায় যা ‘দলীয় গণতন্ত্র’, বাস্তবে তা সর্বোচ্চ নেত্রীর ইচ্ছার অনুসারী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছত্রছায়া ছাড়লে একা অভিষেক কতটা কী করতে পারবেন, সেই কঠিন পরীক্ষা এখনও বাকি। আরও বড় কথা, তৃণমূলের মতো একক নেতৃত্বের দলে ক্ষমতা যেখানে কেন্দ্রীভূত, অর্থাৎ যিনি ‘দিতে’ পারেন, নবীন-প্রবীণ সকল প্রত্যাশীর ভিড় স্বাভাবিক ভাবে সেখানেই জমে থাকে। তাই নেত্রী যত ক্ষণ ক্ষমতাসীন, তত ক্ষণ তিনিই তৃণমূলের প্রথম ও শেষ ঠিকানা বলে গণ্য, সন্দেহ নেই। তবে নেতৃত্বের ও ব্যক্তিত্বের এই টানাপড়েন-এর মধ্যে যা আটক পড়ে গিয়েছে, তা হল পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement