সম্প্রতি বিভিন্ন রাজ্যের রাজকোষের হাল যাচাই করে কোন রাজ্য কতখানি বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে, তার রিপোর্ট প্রকাশ করেছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া। সেখানে সবচেয়ে করুণ অবস্থায় থাকা পাঁচটি রাজ্যের অন্যতম হিসেবে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গের নাম। আগামী দিনে এই রাজ্যের ঋণের বোঝা আরও বাড়বে বলেও থাকছে আশঙ্কা। সেই সূত্রেই ঋণের বোঝা কমানোর ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গকে সতর্ক করেছে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক। দীর্ঘ দিন যাবৎ জাতীয় গড়ের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের ঋণের পরিমাণ বেশি। যেমন, ২০২০-২১ অর্থবর্ষে যেখানে দেশের রাজ্যগুলির গড় ঋণের পরিমাণ তাদের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা গ্রস স্টেট ডোমেস্টিক প্রডাক্ট-এর (জিএসডিপি) ৩১.৩ শতাংশ ছিল, সেখানে এ রাজ্যের ঋণের পরিমাণ ছিল তার মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ৩৭ শতাংশ। আগের দুই অর্থবর্ষে এই অনুপাত যথাক্রমে ৩৫.৬৮ শতাংশ এবং ৩৬.৮৯ শতাংশ থাকলেও, ২০২১-২২ অর্থবর্ষে কোভিডের কারণে রাজ্যের আয় কমায় এবং ব্যয়ের পরিমাণ বাড়ায়, জিএসডিপি-র অনুপাতে ঋণের পরিমাণ বেড়েছে।
কিন্তু, শুধু মোট ঋণের অঙ্ক দেখে বোঝা সম্ভব নয় যে, সংশ্লিষ্ট রাজ্যের ক্ষেত্রে ওই ঋণের পরিমাণ বিপজ্জনক কি না। প্রশ্ন হল, ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধির হার আয়বৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি না কম। যদি আয়ের চেয়ে ঋণ কম হারে বৃদ্ধি পায়, তা হলে সেই রাজ্যের পক্ষে ঋণ বহন করা সম্ভব। সাম্প্রতিক কালে রাজ্যের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের সাপেক্ষে ঋণের অনুপাত প্রায় ধারাবাহিক ভাবে কমেছে। ফলে বলা চলে যে, পশ্চিমবঙ্গ ঋণ বহন করতে সক্ষম। যদিও ঋণের সবচেয়ে নেতিবাচক দিকটি হল রাজ্যের ব্যয়যোগ্য টাকা থেকে ঋণের যে সুদ গুনতে হয়, সেই অর্থ উন্নয়নের কাজে ব্যবহার করা যায় না। অবশ্য পরিসংখ্যান বলছে, ২০১০-১১ সালে রাজ্যের মোট রাজস্ব আদায়ের যত শতাংশ যেত সুদ মেটাতে, সময়ের সঙ্গে তা কমেছে। অর্থাৎ, ঋণের পরিমাণ বাড়লেও একই সঙ্গে রাজস্বের অনুপাতও বেড়েছে, যা উন্নয়নের খাতে ব্যবহৃত হতে পারে। তাল মিলিয়ে কমেছে রাজ্যের জিএসডিপি-র অনুপাতে সুদের পরিমাণও। এই সূত্রে উল্লেখ্য, উন্নয়ন খাতে মোট রাজস্ব ব্যয়ের যত শতাংশ ব্যবহার হয়, তার নিরিখে মাঝারি সারিতে রয়েছে এই রাজ্য। রাজ্যের সুস্থায়ী ঋণ সংক্রান্ত রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার সাম্প্রতিক সমীক্ষায় প্রকৃত এবং অনুমিত পরিসংখ্যান নিয়ে গণনা বলছে, ২০১৮-১৯ থেকে ২০২২-২৩ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের বৃদ্ধির হার সুদের হারের থেকে বেশি ছিল। এই একই সময়ে জিএসডিপি-র বৃদ্ধির হার ঋণের পরিমাণের বৃদ্ধির হারের থেকে বেশি থেকেছে অতিমারির বছর বাদে বাকি বছরগুলিতে। ফলে, রাজ্যের ঋণের ঝুঁকি নিয়ে এতখানি উদ্বেগের কারণ আছে বলে মনে হয় না।
তাই বলে যে সমস্যা একেবারে নেই, তা-ও নয়। ব্যাঙ্কের পরিসংখ্যান বলছে, চার বছর পরে রাজ্যের ঋণের পরিমাণ জিএসডিপি-র ৩৭ শতাংশ থাকে। যার অর্থ, পশ্চিমবঙ্গ তার ঋণের বোঝা কোনও ভাবে সামাল দিলেও, তা কমাতে পারবে না। কিন্তু, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক এই সংখ্যাটিতে কী ভাবে পৌঁছল, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এবং, সংখ্যাটি যথাযথ হলেও মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো নয়। তা হলে, এত উদ্বেগ কিসের?