বিষবৃক্ষের অঙ্কুর দেখা দেওয়া মাত্র তাকে নির্মূল করাই কর্তব্য। মৃত্যুর শংসাপত্র দেবেন গ্রামীণ চিকিৎসকরা, এই দাবিকেও তেমনই কঠোর ভাবে দমন করতে হবে প্রশাসনকে। আইন, নৈতিকতা, প্রশাসনিক নীতি, জনকল্যাণ— কোনও নিরিখেই এর কিছুমাত্র সমর্থন খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। এই দাবির সপক্ষে যে যুক্তিই খাড়া করা হোক, তা বিজ্ঞান এবং সুপ্রশাসনের বিপরীতে দাঁড়াবে। রাষ্ট্রব্যবস্থার কাছে মৃত্যু সাধারণ জ্ঞানের বিষয় নয়। ব্যক্তির জীবন অতি গুরুত্বপূর্ণ বলেই, জীবনাবসান ঘোষণা করতে পারেন কেবল তাঁরাই, রাষ্ট্র যাঁদের সে দায়িত্ব দিয়েছে। অর্থাৎ, নথিভুক্ত চিকিৎসকেরা। গ্রামীণ চিকিৎসকের শংসাপত্র কর্মক্ষেত্রে অসুস্থতার ছুটির আবেদনেও গৃহীত হয় না। অ-চিকিৎসক প্রদত্ত মৃত্যু-শংসাপত্র রাষ্ট্র গ্রহণ করবে, এ তো অকল্পনীয়। গ্রামীণ চিকিৎসকদের ‘স্বাস্থ্যকর্মী’-র শংসাপত্র দেওয়া হয়, তাঁদের চিকিৎসক বলে দাবি করার প্রশ্নই ওঠে না। বেআইনি পথে তাঁদের চিকিৎসক হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার চেষ্টা হলে তা প্রতিরোধ করাই কর্তব্য।
মৃত্যু ঘোষণা একটি আইনি প্রক্রিয়া, সেখানে ঘুরপথে আবছায়া সৃষ্টির চেষ্টা সর্বশক্তিতে প্রতিরোধ করা দরকার। অ-চিকিৎসক দিয়ে মৃত্যুর শংসাপত্র দেওয়ার দাবি আসছে গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে, এই সংবাদ পীড়াদায়ক। স্থানীয় স্বশাসনের বনিয়াদি প্রতিষ্ঠান গ্রাম পঞ্চায়েত সরকারি ব্যবস্থারই অঙ্গ। সরকারের কোনও একটি মহল থেকে আইনের বিপরীতে দাঁড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে কেন, তা দেখা দরকার। এত দিন গ্রামে চিকিৎসক-প্রদত্ত মৃত্যুর শংসাপত্র ছাড়াই শেষকৃত্য হওয়া সম্ভব ছিল— শংসাপত্র দিত গ্রাম পঞ্চায়েত। সম্প্রতি নিয়ম বদল হয়েছে, চিকিৎসকের নাম ও রেজিস্ট্রেশন নম্বর না দিলে মৃত্যুর শংসাপত্র মিলছে না। প্রত্যন্ত গ্রামে চিকিৎসকের অভাবের জন্য তাই ঘুরপথের সন্ধান চলছে, এবং এক শ্রেণির পঞ্চায়েত সদস্য তাকে সমর্থন করছেন। তাঁরা সম্ভবত বড় বিপদগুলি বুঝতে পারছেন না। সর্বাধিক বিপদ অবশ্যই অপরাধের প্রশ্রয়। কোনও মৃত্যু স্বাভাবিক না কি অস্বাভাবিক, সে বিষয়ে পুলিশ বা আদালত প্রশ্ন তুললে বিধিলঙ্ঘনের দায়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি ব্যক্তি আইনের চোখে অপরাধী বলে গণ্য হবেন। এমনকি স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারাও আদালতে প্রশ্নের মুখে পড়তে পারেন, এমন বেআইনি কাজ প্রতিরোধে ব্যর্থতার জন্য। হাঁসখালির গণধর্ষিতা কিশোরীর দাহসংস্কারের ঘটনাই দেখিয়েছে, শিথিলতার সুযোগে কত ভয়ানক অপরাধ ঘটতে পারে।
মৃত্যুর শংসাপত্র পাওয়ার সমস্যার সমাধান অনেক ভাবে হতে পারে। প্রত্যন্ত এলাকাতেও প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র রয়েছে, সেখানে ডাক্তারের উপস্থিতি এবং তৎপরতা নিশ্চিত করতে হবে প্রশাসনকে। বিশেষ ক্ষেত্রে সরকারি স্বাস্থ্যকর্মীকে সংযুক্ত করে, টেলিমেডিসিনের দ্বারা নথিভুক্ত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া যায় কি না, বিবেচনা করতে হবে। মোট কথা, এই ব্যবস্থার সমাধান স্বাস্থ্য দফতরকে বিধিসম্মত উপায়ে করতে হবে। মৃত্যু নির্ধারণ, মৃত্যুর কারণ নির্ধারণ, এই দু’টিই করতে হয় শংসাপত্র দিতে গেলে। আপাতদৃষ্টিতে প্রাণশূন্য ব্যক্তিরও চিকিৎসার অবকাশ থাকতে পারে। ভ্রান্ত, বা অস্পষ্ট কারণের উল্লেখ থাকলে রোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থা ক্ষুণ্ণ হয়। গ্রামীণ চিকিৎসকের মৃত্যুর শংসাপত্র দানের দাবি সব অর্থেই জনস্বার্থের বিরোধী।