এক বছরে একান্ন হাজার সরকারি স্কুল বন্ধ হয়ে গিয়েছে দেশ জুড়ে। জেলা থেকে সংগৃহীত সরকারি তথ্যের প্রাথমিক বিশ্লেষণ দেখাচ্ছে, ২০১৮-১৯ সালে সরকারি স্কুলের প্রায় পাঁচ শতাংশ বন্ধ হয়ে গিয়েছে, সেগুলির অধিকাংশই প্রাথমিক স্কুল। পাশাপাশি খুলেছে এগারো হাজারেরও বেশি নতুন বেসরকারি স্কুল। এ হল অতিমারির আগের পরিস্থিতি। অতিমারি-পরবর্তী সময়ে সরকারি-বেসরকারি স্কুলের অনুপাত কেমন, তা এখনও জানা নেই। তার আগেই সরকারি স্কুলের সংখ্যায় হ্রাস, বেসরকারিতে বৃদ্ধির এই চিত্র মিলেছে। কী বার্তা বহন করছে এই পরিসংখ্যান? মনে রাখতে হবে, স্কুলের সংখ্যার আধিক্যই প্রধান বিবেচ্য নয়। শিক্ষার অধিকারের সুরক্ষার জন্য প্রয়োজন দেশের সব শিশুকে শিক্ষার বৃত্তে নিয়ে আসা। তার জন্য স্কুলের দূরত্ব অল্প, শিক্ষার মান উন্নত, এবং খরচ সাধ্যের মধ্যে হওয়া দরকার। এই শর্তগুলি পূরণ করলে সরকারি বা বেসরকারি, যে কোনও স্কুলই শিশুর শিক্ষার অধিকার বাস্তবায়িত করতে পারে। বেসরকারি স্কুলের খরচ সাধ্যের অতিরিক্ত হওয়ার জন্য যদি শিক্ষা থেকে শিশু বঞ্চিত হয়, তা অবশ্যই উদ্বেগের বিষয়। তাই সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার যথেষ্ট প্রসার প্রয়োজন। কিন্তু স্কুলে শিক্ষক নিয়মিত উপস্থিত না থাকলে, যথাযথ পাঠদান ও মূল্যায়ন না হলে অভিভাবকরা স্কুলের প্রতি বিমুখ হন। এই রাজ্যে তা একটি স্পষ্ট বাস্তব। এই কারণেই দেখা যায়, দরিদ্র বা অসচ্ছল পরিবারও কোনও মতে সাধ্যাতিরিক্ত খরচ করে বেসরকারি স্কুলে সন্তানকে ভর্তি করছে, উন্নত শিক্ষালাভের আশায়। এর ফলেই দেশ জুড়ে সরকারি স্কুলে ছাত্রের অভাব দেখা যাচ্ছে। শিক্ষার মানের অবনমনের কথা আর না-ই বা তোলা হল!
এই পরিস্থিতিতে সরকারি তরফেই কিছু স্কুল জুড়ে দেওয়ার প্রস্তাব উঠেছিল। শিক্ষার অধিকার আইন অনুসারে, কেবল ছাত্রের সংখ্যার অনুপাতে শিক্ষক নিয়োগই যথেষ্ট নয়, প্রতিটি শ্রেণির জন্য এক জন শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। যে প্রাথমিক স্কুলে পঁচিশ-তিরিশ জন ছাত্রছাত্রী, সেখানে পাঁচটি শ্রেণির জন্য পাঁচ জন শিক্ষক নিয়োগ করলে তা অর্থ ও মানবসম্পদের অপব্যয়। তাই, ২০১৭ সালে নীতি আয়োগ প্রয়োজনে একাধিক স্কুল মিলিয়ে দেওয়ার নীতিকে অনুমোদন করে। পরবর্তী বছরগুলিতে কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রক এ বিষয়ে উৎসাহিত করে বিভিন্ন রাজ্যকে। সেই অনুসারে উত্তরপ্রদেশ সরকার ছাব্বিশ হাজার সরকারি স্কুল বন্ধ করেছে, মধ্যপ্রদেশ বাইশ হাজার, ওড়িশা পাঁচ হাজার, অন্য রাজ্যগুলিও বেশ কিছু স্কুল কমিয়েছে। ব্যতিক্রমী রাজ্যগুলির মধ্যে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। ২০১৮-১৯ সালে এ রাজ্যে স্কুলের সংখ্যা হাজারখানেক বেড়ে দাঁড়িয়েছিল তিরাশি হাজার। কেবল তা-ই নয়, সম্প্রতি রাজ্য সরকার ৬৮৬১টি অতিরিক্ত পদ তৈরির কথা ঘোষণা করেছে, যার মধ্যে রয়েছে কর্মশিক্ষা, শারীরশিক্ষার শিক্ষক পদও।
এতে কি রাজ্যবাসী আশ্বস্ত হবেন? আক্ষেপ, নতুন পদ তৈরি, নতুন নিয়োগের সংবাদ চাকরিপ্রার্থীর কাছে যতটা সুখবর, শিক্ষার্থীর কাছে ততটা নয়। সর্বশিক্ষা মিশনের দুই দশক পার হয়েছে, শিক্ষার অধিকার আইনও এক দশক পার হয়েছে। অনেক নতুন স্কুল ও শ্রেণিকক্ষ তৈরি হয়েছে। তবু আজও পশ্চিমবঙ্গে প্রতি বছর পাঁচ-ছয় লক্ষ পড়ুয়া স্কুলের পাঠ শেষ করার আগেই সরে যায় স্কুল থেকে। বহু পড়ুয়া সরকারি স্কুলে নাম লিখিয়েও অনুমোদনহীন বেসরকারি স্কুলে পাঠগ্রহণ করে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের জন্য সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের যথাযথ বণ্টন হয় না। তাই প্রান্তিক এলাকায় শিক্ষাবঞ্চনা অধিক। সরকারি স্কুল বন্ধ হবে কি খোলা থাকবে, তা শিক্ষার্থীর প্রয়োজন অনুসারে ঠিক করতে হবে। স্কুল খোলা রাখাটুকুই সরকারের সদিচ্ছার স্বাক্ষর, এমন কিন্তু বলা যায় না।