প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
সরকারি অব্যবস্থায় চালিত, দুর্নীতি-তাড়িত, মাঝেমধ্যে গণতান্ত্রিকতার ধুয়ো-সর্বস্ব একুশে আইন লালিত এই বঙ্গে স্কুল শিক্ষার দুরবস্থা চরমে পৌঁছেছে। অথচ এখনও এই সরকারি ও সরকার-পোষিত স্কুলেই এ বঙ্গের শিক্ষার্থীদের বৃহদংশ পড়াশোনা করে। অসরকারি শিক্ষাব্যবস্থা পশ্চিমবঙ্গের আর্থসামাজিক পরিবেশে যথার্থ বিকল্প হতে পারে না। নিতান্ত ব্যবসায়িক স্বার্থে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা নানা চেহারার অসরকারি উদ্যোগে, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, খাঁচার উন্নতি হয় কিন্তু পাখির সুশিক্ষা হয় না। এরই মাঝে কিছুটা আশা জাগিয়ে চলেছেন নানা ব্যক্তি-মানুষ ও সংগঠন। তাঁরা অনেকেই গ্রামে গ্রামে যাচ্ছেন। বিভিন্ন পরিসরে, এমনকি প্রয়োজনে গৃহস্থের উঠোনে শিক্ষার্থীদের বসিয়ে অবসর সময়ে লেখাপড়া শেখাচ্ছেন। অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী-অধ্যাপক বাড়ির ফেলে দেওয়া জিনিসপত্র দিয়ে নানা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা দেখিয়ে শিক্ষার্থীদের বিস্মিত করে দিচ্ছেন। বিস্ময়বোধ আর কৌতূহলই তো শিক্ষার্থীদের প্রশ্নশীল করে তোলে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এই সব সদিচ্ছা ও উদ্যোগের মাধ্যমে কতটুকুই বা করা সম্ভব? সবার আগে কি সরকারের অপদার্থতার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, গণ-আন্দোলন গড়ে তোলা অত্যাবশ্যক নয়? সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলির অপদার্থতা ও অনাচার বন্ধ করে তাদের সুপথে ফেরানোর উদ্যোগ করলে তবেই তো শিক্ষাক্ষেত্রে সুবাতাস বইতে পারে! এমন সংশয়ও দেখা দিতে পারে যে— সেই প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক আন্দোলনের পরিবর্তে নীরব বা কর্মমুখী সামাজিক উদ্যোগ সরকারের সমালোচনা না করার কৌশল হয়ে দাঁড়ায় না তো? যা সরকারের করণীয়, তা করার জন্য সরকারকে বাধ্য করাই তো নাগরিক সমাজের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য! এই যুক্তি অর্থহীন নয়, নতুনও নয়। কিন্তু শিক্ষাসংস্কারের বিষয়টিকে ‘হয় প্রতিবাদ, নয় কর্মোদ্যোগ’— এমন কোনও দ্বৈতবাদী বৈপরীত্যের ছকে বেঁধে ফেলবার কিছুমাত্র প্রয়োজন নেই। বস্তুত, তেমন ছক মানতে গেলে উল্টো বিপত্তির আশঙ্কাও প্রবল হয়ে উঠতে পারে। ইতিহাসের সাক্ষ্য মানলে বলতে হয়, নিজেদের দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার জন্য অনেক সময় নাগরিক সমাজ আপাত উত্তেজনার পথ গ্রহণ করে। এতে মুখে আলো পড়ে, উত্তেজনা পোহানোও সম্ভব হয়, নিজেদের বিপ্লবী বলে প্রচারও করা যায়। সাময়িক চাপে পড়ে সরকার হয়তো তাৎক্ষণিক কিছু একটা করে, বা করার ভান করে। তার পর যে তিমির, সেই তিমির।
রবীন্দ্রনাথ বিষয়টির গভীরে প্রবেশ করেছিলেন। ঔপনিবেশিক প্রশাসনের বিরুদ্ধে উত্তেজিত হয়ে আন্দোলন না করে গঠনমূলক স্বাদেশিকতায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। প্রশ্ন হল, বঙ্গভঙ্গ পর্বের ক্ষণিক রাজনৈতিক প্রত্যক্ষতা থেকে সরে এসে গঠনমূলক স্বাদেশিকতায় তিনি প্রবৃত্ত হলেন কেন? দেশের মানুষের শিক্ষা-স্বাস্থ্য বিষয়ে শাসকের নির্বিকারত্বের বিপরীতে পল্লি পুনর্গঠনের উদ্যোগ হয়ে উঠেছিল সক্রিয় প্রতিবাদ। লক্ষ্য ছিল, গ্রামের মানুষ যদি শিক্ষা-স্বাস্থ্য-অর্থনীতি ইত্যাদি বিষয়ে ক্রমে সহৃদয় সামাজিকদের সহায়তায় স্বনির্ভর হয়ে ওঠেন তা হলে বিদেশি সরকারের কাছে ভিক্ষা চাইবার ইচ্ছে আর থাকবে না। নিজের পায়ে দাঁড়াবার বিকল্প হয় না। কেউ বলতে পারেন, এখন তো স্বদেশি সরকার। সুতরাং প্রতিবাদের মাধ্যমে অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া চাই। তবে গণতন্ত্রে স্বদেশি সরকার যখন নাগরিকদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তখন সেই অধিকার আদায়ের জন্য নাগরিকদের ভিত্তিটিকে সুদৃঢ় করতে হয়। তাই সাধারণ ঘরের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর কাজে যাঁরা অগ্রসর হচ্ছেন তাঁদের উদ্যোগের পরিধি ও গভীরতা যত বৃদ্ধি পায় তত ভাল। সরকারি ও সরকার-পোষিত স্কুলেও এমন অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকা আছেন যাঁরা সদিচ্ছাপরায়ণ। এই সদিচ্ছা থেকে বৃহদাংশিক শিক্ষার্থীদের ভাল করে লেখাপড়া শেখালে গণতন্ত্রের ভিত্তি পোক্ত হতে পারে, যার ফলে প্রতিস্পর্ধী রাজনীতিও বলশালী হবে। প্রসঙ্গত, রবীন্দ্রনাথ ‘ইংরেজ সরকারের দালাল’ বদনাম কুড়িয়েও পল্লি পুনর্গঠন প্রক্রিয়া থেকে সরে আসেননি। শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ে অসহযোগ আন্দোলনের বাতাস বইতে দেননি। তিনি জানতেন বিপ্লবের উত্তেজনার থেকে সুস্থির গঠনমূলকতা বড়। এখন স্কুল স্তরে ঠিকমতো পড়াশোনা শিখে প্রশ্নশীল হয়ে উঠলে এই শিক্ষার্থীরাই পরবর্তী কালে রাজনীতির পরিসরে নিজেদের যথার্থ মত প্রকাশ করতে পারবে, মিছিলের গড্ডল যাতে না-হতে হয় সে জন্য পড়াশোনার সদিচ্ছা-সাধনা এখন এক বড় কাজ।