আলিঙ্গনরত নরেন্দ্র মোদী এবং ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: রয়টার্স।
এত কাল যে গোষ্ঠীটিকে অকিঞ্চিৎকর হিসাবে গণ্য করে এসেছে পশ্চিমি দেশগুলি, সে-ই কি এ বার পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিল তাদের দিকে? কূটনীতির দাবার বোর্ডে কি রাশিয়া এক চালে এগিয়ে গেল? সম্প্রতি রাশিয়ার কাজ়ান-এ অনুষ্ঠিত ব্রিকস-এর বার্ষিক সম্মেলনে তেমনই ইঙ্গিত। প্রসঙ্গত, এ বছরই সংসার বৃদ্ধি হয়েছে ব্রিকস-এর। মস্কোর প্রেসিডেন্ট-পদ কালে ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর এই আন্তর্জাতিক মঞ্চে পূর্ণ সদস্যরূপে যোগ দিয়েছে ইথিয়োপিয়া, মিশর, ইরান এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহি। গোষ্ঠীতে যোগ দিতে আগ্রহী সৌদি আরবও। ব্রিকস-এর সদস্য দেশগুলির রাষ্ট্রনেতা-সহ ত্রিশটিরও বেশি রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বুঝিয়ে দিলেন পশ্চিমের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ‘একঘরে’ হয়ে যায়নি ক্রেমলিন। সম্মেলনে গোষ্ঠী-সদস্যরা গাজ়ায় যুদ্ধবিরতির আহ্বানই শুধু জানালেন না, প্যালেস্টাইনে গণহত্যা ও লেবাননে আক্রমণের জন্য ইজ়রায়েলের তীব্র নিন্দাও করলেন। পশ্চিমের আইনবিরুদ্ধ একতরফা জবরদস্তিমূলক পদক্ষেপ ও নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধেও এককাট্টা হন তাঁরা, যা তাঁদের মতে শুধুমাত্র বিশ্ব অর্থনীতির ক্ষতি করছে না, বহু দেশের সুস্থায়ী উন্নয়নের পথেও বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সদস্য দেশগুলির দাবি, সার্বভৌম সাম্য, ঐকমত্য, এক ন্যায্য আর্থিক এবং বাণিজ্যিক ধারার মতো জোটের বহুবিধ নীতির ফলে এই মঞ্চে যোগ দিতে আগ্রহী আরও বহু দেশ।
এ-যাবৎ বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় চল্লিশ শতাংশ এবং মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের এক-চতুর্থাংশের অংশীদার ছিল ব্রিকস। এ বার সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, ইরান এবং সম্ভাব্য সৌদি আরব— বিশ্বের তিন বৃহৎ তেল উৎপাদনকারী রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্তি নিঃসন্দেহে বিশ্বমঞ্চে ব্রিকসের গুরুত্ব বৃদ্ধি করল। পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর প্রভাব বিস্তারে এই জোটের গুরুত্ব বাড়ল। বিশ্ব ব্যাঙ্ক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভান্ডারের বিকল্প হিসাবে তাদের নিউ ডেভলপমেন্ট ব্যাঙ্ক-কে আরও শক্তপোক্ত করতে চাইছে ব্রিকস। তা ছাড়া, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক লেনদেনে ডলারের আধিপত্য এবং গুরুত্ব হ্রাস এবং আঞ্চলিক মুদ্রার সাহায্যে বিকল্প প্রক্রিয়া গড়ে তোলাও ব্রিকস-এর, বিশেষত রাশিয়া এবং চিনের, অন্যতম লক্ষ্য। এ দিকে, ভারতের ক্ষেত্রে কাজ়ানে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হল চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মোদীর পার্শ্ববৈঠক। পূর্ব লাদাখের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা (এলএসি)-য় সংঘাতের অবসান ঘটাতে সমঝোতা হয় দু’তরফে।
তবে সমস্যাও বহুবিধ। আন্তর্জাতিক বাজারে লেনদেনে ডলারের আধিপত্য খর্ব করা সম্ভব হবে কি না, প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। তা ছাড়া সদস্য সংখ্যাবৃদ্ধির সঙ্গে তাদের ভিন্ন অর্থনৈতিক ক্ষমতা ও ভূরাজনৈতিক স্বার্থের জেরে গোষ্ঠীর ভারসাম্য বজায় রাখা সহজ নয়। বিশ্ব অর্থনীতির চালক আমেরিকা-সহ জি৭-এর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে ব্রিকস-কে গড়ে তুলতে আগ্রহী চিন এবং রাশিয়া, এও সর্বজনবিদিত। আগামী দিনে নতুন অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে কোনও দেশের নিজস্ব স্বার্থ যাতে প্রাধান্য না পায়, তা নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে ভারতকে। ভারত-সহ ব্রিকস-এর অন্য সদস্যদের যেখানে পশ্চিমের দেশগুলির সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক রয়েছে, সেখানে নিজেদের স্বার্থেই কেউ সেই সম্পর্কের অবনতি চাইবে না। এই গোষ্ঠীর কার্যকারিতার চাবিকাঠিটি তাই ভারসাম্য।