২৬ জুন তিস্তাকে গ্রেফতার করেছিল গুজরাত পুলিশ।
নিতান্তই অন্তর্বর্তী জামিন, জানিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। তিস্তা শেতলবাড়ের মামলার ফয়সালা করবে গুজরাত হাই কোর্টই। কিন্তু, ভারতীয় বিচারব্যবস্থার বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে এই অন্তর্বর্তী জামিনের সিদ্ধান্তটির গুরুত্ব অতুলনীয়। ২৬ জুন তিস্তাকে গ্রেফতার করেছিল গুজরাত পুলিশ। অগস্টের গোড়ায় গুজরাত হাই কোর্টে তাঁদের জামিনের আবেদনটির শুনানি হয়। আদালত পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করে সেপ্টেম্বরের ১৯ তারিখ। সুপ্রিম কোর্ট প্রশ্ন করেছে, গুজরাত হাই কোর্টে জামিনের শুনানিকে ছয় সপ্তাহ পিছিয়ে দেওয়া— অর্থাৎ অভিযুক্তকে এই সময়কালে বন্দি থাকতে বাধ্য করা— কি স্বাভাবিক ঘটনা? অনুমান, প্রশ্নটির মধ্যে ভিন্নতর একটি প্রশ্ন রয়েছে: তিস্তার ক্ষেত্রে জামিনের আবেদনের শুনানিতে এমন বিলম্ব কি তাঁকে হেনস্থা করার জন্যই? গুজরাত মামলায় নরেন্দ্র মোদীকে নির্দোষ ছাড়পত্র দিয়েছিল বিশেষ তদন্তকারী দল— সেই সিদ্ধান্তকে বহাল রেখে জুন মাসে সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দিয়েছিল, তাতে কিছু বাড়তি কথাও ছিল। আদালত বলেছিল, যারা নিজেদের স্বার্থে এই মামলাকে জিইয়ে রেখেছে, এই বার তাদেরও আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন। আদালতের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা বজায় রেখেও বলা প্রয়োজন, গুজরাত পুলিশ আদালতের এই পর্যবেক্ষণটিকে পুরনো শত্রুতার হিসাব মেলাতে অতি দ্রুত এবং অতি সক্রিয় ভঙ্গিতে ব্যবহার করেছে। রায়দানের পরের দিনই গ্রেফতার করা হয় তিস্তা এবং আর বি শ্রীকুমারকে, গুজরাত দাঙ্গা প্রসঙ্গে গুজরাতের বিজেপি সরকারের সঙ্গে যাঁদের বিরোধের দুই দশক পূর্ণ হল এ বছর। কার্যত কল্পিত একটি অপরাধ বিষয়ে অভিযোগের ভিত্তিতে কাউকে গ্রেফতার করা, এবং বিনা জামিনে বন্দি রাখাও কি আজকের ভারতে স্বাভাবিক ঘটনা?
প্রশ্নটির উত্তর ভারত জানে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থেকে অশীতিপর পাদরি বা কবি, যে কোনও বিরুদ্ধ স্বরকে বিনা বিচারে, বিনা জামিনে বন্দি করে রাখা নরেন্দ্র মোদীর ভারতের অভিজ্ঞানে পরিণত হয়েছে। তিস্তাকে অন্তর্বর্তী জামিন দেওয়ার সিদ্ধান্তের ভিতরে কি এই ইঙ্গিতও আছে যে, বিনা বিচারে রাজনৈতিক বিরোধীদের বন্দি করে রাখার প্রবণতাটি শীর্ষ আদালতের কাছে অগ্রহণযোগ্য? অশীতিপর কবি ভারাভারা রাও জামিন পেলেন চার বছর পরে; স্বাস্থ্যের কারণে বারংবার জামিনের আবেদন করেও জেলবন্দি অবস্থাতেই মারা গেলেন স্ট্যান স্বামী। তিস্তাকে অন্তর্বর্তী জামিন মঞ্জুর করার মধ্যে অন্যান্য মামলার প্রতিও ইঙ্গিত রয়েছে কি? গুজরাত হাই কোর্টের অবস্থান নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের সপ্রশ্ন পর্যবেক্ষণও ভারতীয় বিচারব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা মজবুত করতে পারে। বিশেষত, শাসকরা যখন সংবিধানের তোয়াক্কা না করে বিরোধীদের শায়েস্তা করতে ব্যাকুল, তখন আদালতই শেষ ভরসা। ভারতীয় আইনব্যবস্থা স্বাভাবিক ভাবে জামিনে বিশ্বাসী— একান্ত ব্যতিক্রমী কিছু ক্ষেত্র বাদে নির্দিষ্ট সময়ের পর জামিন দেওয়াই বিধেয়। তিস্তার ক্ষেত্রেও আদালত কথাটি স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। তিস্তার অন্তর্বর্তী জামিনের বিরোধিতা করে সুপ্রিম কোর্টে সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা বলেছিলেন, এই জামিন হলে তা (নেতিবাচক) দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। অনুমান, শীর্ষ আদালত দৃষ্টান্তই স্থাপন করতে চেয়েছে। বিচারব্যবস্থা যে রাজনীতির অঙ্গুলিহেলনে পরিচালিত হয় না, তার ইতিবাচক দৃষ্টান্ত।