বিবিধ রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যে অনেক জরুরি সংবাদ চাপা পড়ে যায়। তেমনই একটি সংবাদ শোনা গিয়েছিল নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে। ভারতের সর্বোচ্চ আদালত সংবিধান বিষয়ক একটি অত্যন্ত গুরুতর পর্যবেক্ষণ করে এই মর্মে যে, ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ও ‘সমাজতান্ত্রিক’ শব্দ দু’টি সংবিধানের মুখবন্ধে যোগ করার বিষয়টিকে নতুন করে কাঠগড়ায় তোলার কোনও দরকার নেই। গত কিছু বছর ধরেই দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দলসমূহ বিভিন্ন পন্থায় বিভিন্ন মঞ্চে প্রচার করে চলেছে যে, জরুরি অবস্থাকালে সংবিধানের ৪২তম সংশোধনীতে এই দু’টি শব্দ যোগ করার ফলে রাষ্ট্রীয় চরিত্রটিকে পাল্টানো, এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুকে বিশেষ রকম ‘তোষণ’মূলক দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা হয়েছিল। সুতরাং শব্দগুলিকে বাদ দিতে হবে। সেই মর্মেই একটি মামলা সর্বোচ্চ আদালতে পৌঁছলে মাননীয় বিচারপতিরা স্পষ্ট একটি সূত্র দেন। সূত্রটি আসে সংবিধানের একেবারে প্রধান বক্তব্য থেকে, যেখানে আইনের সামনে সকল নাগরিকের সমতার উপর জোর দেওয়া হয়েছিল, এবং নাগরিকের যে কোনও ধর্ম, বিশ্বাস, আচার পালনের স্বাধীনতা স্বীকার করা হয়েছিল। এই যে বক্তব্য— একেই এক কথায় ধর্মনিরপেক্ষ বলা যায়, এর থেকে বেশি কিছু পরবর্তী কালের সংশোধনেও বোঝাতে বা প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়া হয়নি: বিচারপতিরা বলেন।
‘সমাজতান্ত্রিক’ শব্দটি সংবিধানে থাকবে কি না, এই নিয়ে সংবিধান সভাতেও প্রচুর আলোচনা চলেছিল, শেষ অবধি বাবাসাহেব আম্বেডকরের একটি সংশয়ের কারণে শব্দটি আর প্রবিষ্ট হয়নি। আম্বেডকরের মনে হয়েছিল, পরপ্রজন্মকে কোনও একটি বিশেষ অর্থনৈতিক পথ নিতে সংবিধানমতে বাধ্য করা উচিত নয়। লক্ষণীয়, বিশ শতকের মধ্যভাগে সমাজতন্ত্র বলতে যে সুনির্ধারিত মতবাদ বোঝানো হত, ভারতীয় সংবিধানে কিন্তু তা বলতে চাওয়া হয়নি। ১৯৭৬ সালে সংবিধান সংশোধনের সময়েও সমাজতন্ত্রের অর্থটি সচেতন ভাবে সীমিত রাখা হয়েছিল— শ্রেণি গোষ্ঠী ধর্ম লিঙ্গ নিরপেক্ষ ভাবে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। বিচারপতিরা আর একটি খুব জরুরি কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন— প্রশ্ন তোলার মানেই পিছু হটা নয়। কেন এই সংশোধন করা হল, সেই প্রশ্ন তোলাই যায়। কিন্তু তাই বলে সংশোধন বাতিল করে দেওয়ার মতো পদক্ষেপ— অপ্রয়োজনীয়। এর কারণ, দু’টি শব্দের কোনওটিতেই ভারতীয় সংবিধানের চরিত্রের কেশাগ্রমাত্র পরিবর্তন ঘটানো হয়নি। যা আগে ছিল, তাকে স্পষ্টতর করা হয়েছে মাত্র। এবং, ১৯৭৬ সালের ঢের আগে থেকে শব্দ দু’টির সুর যে শুধু ভারতীয় সংবিধানেই ছিল, তা নয়— স্বাধীনতা-উত্তর ভারতীয় জাতিরাষ্ট্রের ধারণার একেবারে গোড়ায় যে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র থাকবে, তা স্থির হয়েছিল দেশ স্বাধীন হওয়ার অন্তত দেড়-দু’দশক আগেই। বিরোধ ছিল, কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল ধারণা দু’টির পক্ষে সমর্থন। উন্নয়নের সূত্র ধরে জাতীয়তার যে সংজ্ঞা ভারতনির্মাণের প্রাণকেন্দ্রে রয়েছে, তার জন্য ধর্মনিরপেক্ষতা ও সামাজিক ন্যায়কেন্দ্রিক সমাজতন্ত্রের ধারণা অপরিহার্য।
বিজেপি শাসিত ভারতে যে ভাবে সংখ্যালঘু-বিরোধিতা বেড়েছে, এমনকি রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমেও বৈষম্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাতে সুপ্রিম কোর্টের সংবিধান বিষয়ক এই বক্তব্যটির গুরুত্ব অপরিসীম। তাঁরা এও মনে করিয়ে দিয়েছেন যে জরুরি অবস্থা শেষে ১৯৭৮ সালে সংবিধানের ৪৪তম সংশোধনীর সময়ও বিষয়টি বিশদে আলোচিত হয়েছিল। এবং তখন বিচারবিভাগের শীর্ষে ছিলেন যাঁরা, তাঁরাও এই মত প্রদান করেছিলেন। রাজনীতির কূটচক্রে সাংবিধানিক আদর্শের গতি ঘুরিয়ে দেওয়া যায় না। ১৯৭৬ সালের সংশোধনীতে সেই গতি ঘুরিয়ে দেওয়া হয়নি, কেবল নবরূপে সংযোজিত হয়েছিল মাত্র। এখন আবার সেই সংযোজনকে রাজনীতির প্রয়োজনে মুছে দেওয়ার চেষ্টা— পরিত্যাজ্য।