সিদ্দিক কাপ্পান।
তিস্তা শেতলবাড়ের পর সিদ্দিক কাপ্পানকেও জামিন দিল সুপ্রিম কোর্ট। এই বারও শীর্ষ আদালত কিছু তীক্ষ্ণ প্রশ্ন করেছে প্রশাসন ও নিম্নতর আদালতের উদ্দেশে। আদালত মনে করিয়ে দিয়েছে যে, দেশের প্রত্যেক নাগরিকের বাক্স্বাধীনতা আছে, এবং কাপ্পান তাঁর সেই অধিকার ব্যবহার করে হাথরসের ধর্ষিতার জন্য ন্যায়বিচারের দাবি করছিলেন মাত্র। শীর্ষ আদালতের প্রশ্ন, ভারতের আইনব্যবস্থা কি এই আচরণকে অন্যায় মনে করে? প্রধান বিচারপতি ইউ ইউ ললিতের নেতৃত্বাধীন তিন বিচারপতির বেঞ্চ নাগরিকের প্রতিবাদের অধিকারের কথা যেমন স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, তেমনই ২০১২ সালের নির্ভয়া কাণ্ডের পর হওয়া প্রতিবাদের উল্লেখ করে বলেছে যে, মানুষের সেই বিক্ষোভ রাষ্ট্রের আইনেও পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। শীর্ষ আদালতের কথাগুলির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এটাও লক্ষণীয় যে, অগস্টের শেষে বিচারপতি ললিত প্রধান বিচারপতির পদে আসীন হওয়ার পর উদার গণতন্ত্রের পক্ষে আদালতের অবস্থান অতি স্পষ্ট হয়েছে। ভারতের দুর্ভাগ্য, আজ়াদির অমৃত মহোৎসব পালনে মগ্ন শাসকদের গণতন্ত্রের প্রাথমিক পাঠগুলিও আলাদা ভাবে স্মরণ করিয়ে দিতে হচ্ছে। কিন্তু, তা-ই যখন বাস্তব, তখন কথাগুলি বারে বারেই বলে যেতে হবে। মনে করিয়ে দিতে হবে যে, শাসক এবং দেশ এক নয়— শাসকের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা দেশদ্রোহ নয়, বরং তা সর্বোচ্চ স্তরের দেশপ্রেম। নিপীড়িত মানুষের পক্ষে দাঁড়ানো, তাঁদের জন্য ন্যায়বিচারের দাবি করা নাগরিক সমাজের অপরিহার্য কর্তব্য। বিশেষ করে এই সময়ে, যখন রাষ্ট্রীয় আগ্রাসন নাগরিক সমাজের প্রতিবাদের পরিসরটিকে ক্রমেই সঙ্কুচিত করছে।
প্রধানমন্ত্রী বারে বারেই রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের কর্তব্যের কথা বলেন। নাগরিকের প্রধানতম কর্তব্য হল, রাষ্ট্রের পরিচালকদের প্রতিটি পদক্ষেপের দিকে দৃষ্টি রাখা; যেখানে সংবিধান-বর্ণিত আদর্শ থেকে বিচ্যুতি ঘটবে, সেখানেই সুতীব্র প্রতিবাদ করা। নরেন্দ্র মোদীর সরকার গত আট বছরে বিভিন্ন অস্ত্রে নাগরিককে এই কর্তব্য থেকে বিরত করতে চেয়েছে। রাষ্ট্রদ্রোহ আইন বা ইউএপিএ-র মতো দানবিক আইন, পিএমএলএ-র যথেচ্ছ ব্যবহার, এবং পুলিশ ও বিভিন্ন তদন্তকারী সংস্থাকে বিরোধী স্বর দমনের কাজে ব্যবহার ইত্যাদি এখন অতি ‘স্বাভাবিক’। ভারতে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, অনেকেই তাকে ‘অঘোষিত জরুরি অবস্থা’ বলছেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে তিস্তা শেতলবাড় বা সিদ্দিক কাপ্পানদের জামিনের সিদ্ধান্তকে রাষ্ট্রক্ষমতার এই বিপুল অপপ্রয়োগের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের সুস্পষ্ট অবস্থান হিসাবে পাঠ করা যেতেই পারে। রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করার, অন্যায় থেকে বিরত হওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করার যে অধিকার সংবিধান প্রতিটি নাগরিককে দিয়েছে, দেশের পরিচালকরা যে কোনও অবস্থাতেই তা কেড়ে নিতে পারেন না, সুপ্রিম কোর্টের রায় সেই কথাটি স্মরণ করিয়ে দেয়। আশা করা যায় যে, প্রধান বিচারপতি ললিতের কার্যকাল শেষ হলেও তাঁর প্রদর্শিত পথটি বিস্মৃত হবে না।
শীর্ষ আদালত তার সাম্প্রতিক রায়গুলিতে কখনও গুজরাত হাই কোর্ট, কখনও ইলাহাবাদ হাই কোর্টের প্রতি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে যে প্রশ্নগুলি করেছেন, সেগুলি প্রণিধানযোগ্য। দেশের বিচারব্যবস্থার প্রতি সম্পূর্ণ আস্থা রেখেও বলতে হয় যে, কারও মনে প্রশ্ন তৈরি হতে পারে— হাই কোর্টগুলির সিদ্ধান্তের সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক শাসকদের স্বার্থের সামঞ্জস্য কি নেহাত সমাপতন নয়? এমন সংশয় ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে অতি দুর্ভাগ্যের। বিচারব্যবস্থার প্রতি প্রশ্নহীন আস্থাই দেশবাসীকে বহু রাজনৈতিক সঙ্কটের সম্মুখীন হতে ভরসা জুগিয়েছে। সেই ভরসাটি থাকা প্রয়োজন। ভারতীয় বিচারব্যবস্থা সর্বদা স্মরণে রাখুক যে, যাবতীয় সংশয়ের ঊর্ধ্বে থাকা তার পক্ষে অত্যাবশ্যক।