রাজ্যের তরফে অন্তত মামলা দায়ের করার অধিকার নিয়ে কোনও প্রশ্ন উঠতে পারে না: এই স্পষ্টোক্তি এসেছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে। সিবিআই ও ইডি তদন্তের নামে রাজ্যের অধিকারে কেন্দ্র হস্তক্ষেপ করছে, এই মর্মে পশ্চিমবঙ্গ সরকার সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিল, এবং কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যের সেই মামলা দায়ের করার অধিকার নিয়ে আপত্তি তুলেছিল। সেই প্রসঙ্গে গত সপ্তাহে বিচারপতিদের বেঞ্চ এই মতামত জানিয়ে দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে কেন্দ্রীয় সরকারকে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছিল, রাজ্য আপত্তি করা সত্ত্বেও সিবিআই-কে তদন্তের অনুমতি দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার অসাংবিধানিক কাজ করছে, এই মর্মে। রাজ্যের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন আইনজীবী কপিল সিব্বল এবং অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি। কেন্দ্রের পক্ষে তুষার মেহতার বক্তব্য ছিল, রাজ্য এই আপত্তি তুলতেই পারে না। বিচারপতি গাভাই এই চাপান-উতোর পেরিয়ে গিয়ে পিছনের বড় মৌলিক নীতির প্রশ্নটিতে জোর দিতে চেষ্টা করেছেন, এবং বলে দিয়েছেন— অসুবিধা নেই, মামলা বিলক্ষণ চলতে পারে।
মাননীয় বিচারপতিরা বলেছেন, অতিরিক্ত রাজনৈতিক রেষারেষি দিয়ে আদালতের বিচারপ্রক্রিয়াকে কলঙ্কিত না করে একেবারে নীতির প্রশ্নটিকে পাখির চোখ করাই বেশি জরুরি। এটা রাজনীতির প্রশ্ন নয়, নীতির প্রশ্ন। কথাটি বর্তমান ভারতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নীতি বিষয়ক আলোচনাকে পিছনের আসনে পাঠিয়ে তর্কবিতর্কের বিষয় হয়ে ওঠে রাজনৈতিক অভিযোগ-প্রত্যভিযোগ, এবং শেষ অবধি এক ধরনের ‘হোয়াটঅ্যাবাউটারি’র কর্ষণ। এই ক্ষেত্রটিতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট বা ইডি-র তদন্তের গতিপ্রকৃতি নিয়ে রাজ্য সরকার আপত্তি তোলা সত্ত্বেও ইডি কোনও বাধা মানেনি, কেন্দ্রীয় সরকার তাকে সম্পূর্ণত ব্যবহার করেছে। স্বাভাবিক ভাবেই স্বনামধন্য দুই আইনজীবীর যুক্তিতর্কে অভিযোগের তির ঘুরে গেছে বিজেপির বিরুদ্ধে। তাঁরা বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গ তৃণমূল কংগ্রেস-শাসিত রাজ্য বলেই রাজ্যে সিবিআই প্রবেশ করলেই সঙ্গে সঙ্গে ইডি নিজেকে জড়িয়ে ফেলছে। মেহতা তাতে পাল্টা বলেছেন, ইডি তদন্তের সূত্রেই কিন্তু রাজ্যের ‘মন্ত্রিবর’-এর কাছ থেকে ৫০ কোটি টাকা উদ্ধার হয়েছে, যা শিক্ষকনিয়োগ সংক্রান্ত বিপুল ও ব্যাপক আর্থিক দুর্নীতির প্রত্যক্ষ প্রমাণ। সিব্বল কোনও উত্তর দেননি এই অভিযোগের। তবে মেহতাকে বিচারপতিরা মনে করিয়ে দিয়েছেন, কথাটা রাজনৈতিক লাভ-লোকসানের নয়, বরং একেবারেই পদ্ধতিগত, এবং সেই সূত্রে, নীতিগত।
এবং, এই নীতির সঙ্গে যুক্ত একটি জরুরি রাষ্ট্রদর্শন, যার নাম যুক্তরাষ্ট্রীয়তা। ২০১৮ সালের নভেম্বরে পশ্চিমবঙ্গ সিবিআই অনুসন্ধানের বিষয়ে রাজ্যের তরফে স্বীকৃতি সরিয়ে নিলেও সিবিআই পর পর ১২টি মামলা দায়ের করেছে রাজ্যের বিরুদ্ধে— যা যুক্তরাষ্ট্রীয়তা নীতির সম্পূর্ণ বিপ্রতীপে যায়। এর ফলে রাজ্য সরকারের দুর্নীতির দিকে কেন্দ্রীয় সরকার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু কেন্দ্রের তরফে এই ‘কনস্টিটিউশনাল ওভাররিচ’ বা সাংবিধানিক অধিকারের মাত্রাতিরিক্ত প্রয়োগের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করবে কে? সেই ভার দেশের বিচারবিভাগের উপরেই বর্তায়। বাস্তবিক, গত দশ বছরে— কেবল পশ্চিমবঙ্গে নয়, নানা প্রদেশে নানা বিষয়ে— কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যের অধিকার সীমিত করে গিয়েছে, রাজ্যকে অবজ্ঞা করে নিজের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করেছে, তা আর কোনও নতুন কথা নয়। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্যটি বিশেষ জরুরি ও সময়োপযোগী। এই বক্তব্যসূত্রে যে ভর্ৎসনা কেন্দ্রীয় সরকারের দিকে ধাবিত হল, তার প্রভাব অন্যান্য ক্ষেত্রেও অনুভূত হবে, এই আশা রইল। নির্বাচনের পর নবনিযুক্ত কেন্দ্রীয় এনডিএ সরকারের ক্ষমতা পরিচালন ও প্রদর্শন বিষয়ে অনেক হিসাবই নতুন করে করতে হচ্ছে: এই ক্ষেত্রটিতেও তৃতীয় দফার মোদী সরকার পথ-সংশোধন করুক।