বিদ্বেষরেখা

ঘরে পুরুষতন্ত্রের রক্তচক্ষু, বাহিরেও নারীবিদ্বেষের লক্ষ্মণরেখা, ভারতীয় নারীসমাজ তাহা হইলে অন্য কোনখানে যাইবে?

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৪ অগস্ট ২০২১ ০৫:০৩
Share:

মিরাবাই চানু, পি ভি সিন্ধু, লাভলিনা বরগোহাঁইরা যখন ভারতের হইয়া অলিম্পিকের আসরে পদক নিশ্চিত করিতেছেন, উত্তরপ্রদেশের সপ্তদশী নেহা পাসোয়ানকে তখন পিটাইয়া মারিয়া ফেলা হইল— জিনস পরিয়াছিল বলিয়া। অভিযুক্তরা বাহিরের কেহ নহে, ঠাকুরদা বা কাকা-জেঠার ন্যায় নিকটাত্মীয়। মোবাইল ফোনে কথা বলিবার ‘অপরাধে’ মধ্যপ্রদেশের দুই কিশোরীকে বেদম প্রহার করিল তাহার পরিবারের সদস্যরাই, চুল ধরিয়া টানিয়া আনিয়া, মাটিতে ফেলিয়া লাথি-ঘুষি, লাঠি ও তক্তা দিয়া মার— সবই ঘটিয়াছে। একই ঘটনা গুজরাতেও, সবক শিখাইবার লোক সেখানে বেশি, আত্মীয়-অনাত্মীয় মিলাইয়া পনেরো জন। ঘরে ও বাহিরে সকলেই সুযোগ বুঝিয়া মেয়েদের শিক্ষা দিতেছে।

Advertisement

এক কিশোরী বা তরুণী কী পরিবেন, কোথায় যাইবেন, কাহার সহিত কী ভাবে কথা বলিবেন, সমস্তই কষিয়া বাঁধিয়া দেয় তাহার নিকট ও দূর সম্পর্কের আত্মীয়, পাড়ার লোক, গ্রামপ্রধান, স্থানীয় গোষ্ঠী বা সমাজ। শ্বশুরবাড়িতে অত্যাচারিত হইয়া পিতৃগৃহে পলাইয়া আসিলে আশ্রয় ও আশ্বাসের পরিবর্তে জুটিতেছে হেনস্থা, প্রহার। উত্তরপ্রদেশ বা মধ্যপ্রদেশের ঘটনাগুলি ঘটিয়াছে শিক্ষা ও অন্য সুযোগসুবিধাহীন প্রত্যন্ত ও অনগ্রসর অঞ্চলে, তাহা বলিয়া স্থানিক অশিক্ষার দোহাই পাড়িয়া বলিবার উপায় নাই যে, বাকি দেশে মেয়েরা ভাল আছে। বিশেষজ্ঞরা বলিতেছেন, গত দেড় বৎসর ধরিয়াই কোভিড-অতিমারির গায়ে গায়ে লাগিয়া আছে মেয়েদের প্রতি হিংসার ‘ছায়া-অতিমারি’— তাহাতে পিতৃগৃহ কি শ্বশুরবাড়ি, মফস্‌সল বা মহানগরে তফাত নাই। দিল্লির জাতীয় মহিলা কমিশনের হেল্পলাইনে গত বৎসর লকডাউনের প্রথম মাসে যত সংখ্যক ফোন আসিয়াছে, তাহার বহুলাংশই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ঘরের অল্পবয়সি মেয়েদের দুর্দশাচিত্র। সুশিক্ষিতা তরুণী লকডাউনে ঘরে কম্পিউটারের সামনে বসিয়া চাকুরি করিয়া বক্রোক্তি শুনিতেছেন, মেয়ে বা বধূ সংসারে সময় দিতেছে না, গৃহে বিদ্যুৎ ও আন্তর্জালের খরচ বেশি হইতেছে! নারীবিদ্বেষ ও হিংসার নানা মুখ— কখনও তাহা আসিতেছে জিনস পরা বা মোবাইলে কথা বলিবার উপরে পিতা, সহোদর, গ্রামের মোড়ল বা অঞ্চলপ্রধানের ফতোয়া ও তৎপরবর্তী উদগ্র অত্যাচারের রূপ ধরিয়া; কখনও সূক্ষ্মদেহে, ঘরের লোক-পাড়াপ্রতিবেশী-সহকর্মীর নিকট হইতেই প্রবল মানসিক চাপ ও অশান্তির কারণ হইয়া।

মেয়েদের সুরক্ষায় আইনের সংখ্যা অনেক— গৃহহিংসা বিরোধী আইন রহিয়াছে, কর্মস্থলে সুপরিবেশ ও সমানাধিকার নিশ্চিত করিবার আইনও। কিন্তু পরিবার ও সমাজ বিমুখ হইলে আইনও কার্যকারিতা হারায়। যে পরিবার ও সমাজে নারী ভ্রূণাবস্থা হইতেই অনাকাঙ্ক্ষিত, বড় হইয়া উঠিবার যাত্রায় প্রতি পদে বিধিিনষেধ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, যে েদশে রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রী তথা সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গও প্রায়শই নারীর আব্রু, পোশাক, পেশা সম্পর্কে নিদান হাঁকিয়া তাহাকে চিরাচরিত গৃহস্থালি ও ত্যাগসর্বস্ব মাতৃত্ব যাপনের সুপরামর্শ দিয়া থাকেন, সেখানে নারী যে বয়স ও সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে বিভেদ-বিদ্বেষের শিকার হইবেন, বুঝিতে বেগ পাইতে হয় না। ঘরে পুরুষতন্ত্রের রক্তচক্ষু, বাহিরেও নারীবিদ্বেষের লক্ষ্মণরেখা, ভারতীয় নারীসমাজ তাহা হইলে অন্য কোনখানে যাইবে?

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement