COVID-19

দায়িত্বজ্ঞানহীন

টিকা লইলে নিজে রোগাক্রান্ত হইবার, অথবা অন্যকে রোগাক্রান্ত করিবার— দুই সম্ভাবনাই কমে। অর্থাৎ, টিকায় প্রাপকের লাভ, অন্যদেরও।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৩ জুন ২০২১ ০৫:০১
Share:

ইউরোপের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট দেশগুলি যে নাগরিকদের কোভিড-এর প্রতিষেধক বিনামূল্যে দিবে, তাহা এক প্রকার অনুমান করা চলে। কিন্তু ধনতন্ত্রের পীঠস্থান আমেরিকায়, যেখানে গণস্বাস্থ্য ব্যবস্থাটি বেশ কিছু দিন রাষ্ট্রের চক্ষুশূল, সেখানেও প্রকৃতার্থেই টিকার উৎসব চলিতেছে— প্রত্যেক নাগরিক নিখরচায় টিকা পাইতেছেন। যে সিঙ্গাপুর দার্শনিক ভাবেই ‘ফ্রি লাঞ্চ’-এর প্রবল পরিপন্থী, সেখানেও নাগরিকরা বিনামূল্যে টিকা পাইতেছেন; দক্ষিণপন্থী রাজনীতির পোস্টারবয় জাইর বোলসোনারো-র ব্রাজিলেও; কর্তৃত্ববাদী রাজনীতির পূণ্যভূমি চিনেও। ভারত আজ দুনিয়ায় একমেবাদ্বিতীয়ম্— এই দেশে নাগরিকদের একটি বড় অংশকে টিকা লইতে হইলে পকেট হইতে টাকা খরচ করিতে হইতেছে। কাণ্ডজ্ঞান বস্তুটি ভারতের শাসকপক্ষের মধ্যে সুলভ নহে— ন্যায্যতা বা নৈতিকতার বোধের প্রসঙ্গকে আলোচনার বাহিরে রাখাই মঙ্গল। ফলে, তাঁহারা ভাবিয়া দেখেন নাই, কেন কার্যত গোটা দুনিয়ায় কোভিডের টিকা বিনামূল্যে দেওয়া হইতেছে। কারণ, অতিমারির প্রতিষেধক শুধু পাবলিক গুড নহে— তাহাকে আন্তর্জাতিক পাবলিক গুড বলা হইতেছে। অর্থাৎ, ইহা এমনই একটি বস্তু, গোটা দুনিয়ার কোনও নাগরিককে যাহার অধিকার হইতে বঞ্চিত করা চলে না। একক নাগরিকের স্বার্থে যতখানি, তাহার অধিক সামগ্রিক স্বার্থে। কারণ, অতিমারি মানুষ হইতে মানুষে ছড়ায়— টিকা প্রয়োগের মাধ্যমে সেই শৃঙ্খল ভাঙা সম্ভব হইলে তবেই এই ব্যাধির বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়িয়া তোলা সম্ভব। টিকা লইলে নিজে রোগাক্রান্ত হইবার, অথবা অন্যকে রোগাক্রান্ত করিবার— দুই সম্ভাবনাই কমে। অর্থাৎ, টিকায় প্রাপকের লাভ, অন্যদেরও।

Advertisement

ইহার নাম পজ়িটিভ এক্সটার্নালিটি, অর্থাৎ ইতিবাচক অতিক্রিয়া। অর্থশাস্ত্রের একেবারে প্রাথমিক কেতাবেও লেখা থাকে যে, কোনও পণ্যের যদি ইতিবাচক অতিক্রিয়া থাকে, তবে বাজার তাহার যথার্থ মূল্য নির্ধারণ করিতে পারে না। কারণ, হোমো ইকনমিকাস বা অর্থনৈতিক মানব অপরের উপকারের কথা ভাবিয়া অর্থব্যয় করিতে সম্মত হইবে না। সেই ক্ষেত্রে পণ্যটি সরবরাহের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কোভিড-এর টিকার ন্যায় পণ্যের ক্ষেত্রে— যেখানে ইতিবাচক অতিক্রিয়াটি আক্ষরিক অর্থেই বিশ্বজনীন— সেই পণ্যটিকে বাজারের হাতে ছাড়িয়া দিবার কথা কট্টর বাজারপন্থীরাও কল্পনা করেন না। চূড়ান্ত দক্ষিণপন্থী রাজনীতিও বলে যে, এই পণ্যের দায়িত্ব সরকারকেই লইতে হইবে। সেই কারণেই শি চিনফিং হইতে জাইর বোলসোনারো, বিনামূল্যে টিকা প্রদানকারীদের তালিকায় বহু অপ্রত্যাশিত নাম উপস্থিত। ব্যতিক্রম এক জন। নরেন্দ্র মোদীর ভারতে অনেকের ক্ষেত্রেই টাকা না থাকিলে টিকাও নাই।

অবশ্য, শুধু নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্যই নহে, এই ভারতে কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যেও বৈষম্য চলিতেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ একাধিক মুখ্যমন্ত্রী যে প্রশ্ন করিয়াছিলেন, সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টও সেই প্রশ্ন করিল— একই দেশে, একই সংস্থা হইতে একই টিকা কিনিতে পৃথক দাম দিতে হইতেছে কেন? যেখানে প্রত্যেক নাগরিকের জন্য বিনামূল্যে টিকার ব্যবস্থা করা জরুরি ছিল, সেখানে ভারতে অনূর্ধ্ব ৪৫ বৎসর জনগোষ্ঠীর সম্পূর্ণ দায়িত্ব রাজ্য সরকারগুলির উপর চাপাইয়া তাহাদের বাধ্য করা হইতেছে অধিক দামে টিকা কিনিতে। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় এই বৈষম্য যে চলিতে পারে না, কেন্দ্রীয় সরকার তাহা বুঝিয়াও বোঝে নাই। তাহারা সুবিধাবাদের যুক্তিতে চালিত— ফলে, রাজ্যগুলির উপর দায় চাপাইয়া যদি নিজেদের রাজস্ব-দায়িত্ব হইতে মুক্তি মিলে, তাহাকে অতিক্রম করিয়া দৃষ্টি প্রসারণের ক্ষমতা এই সরকারের নাই। দেশের নাগরিকের প্রতি দায়িত্বই হউক বা বিশ্বের প্রতি, ভারতের শাসকরা কিছুতেই বিচলিত হন না। ক্ষুদ্রতাই তাঁহাদের মোক্ষ।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement