বড়দিনে পার্ক স্ট্রিটে উপচে পরা ভিড়।
করোনাভাইরাসের মতো ক্রমাগত রূপান্তরশীল একটি শত্রুর সহিত যখন যেমন প্রয়োজন তখন তেমন ভাবেই লড়িতে হইবে, সংক্রমণ মোকাবিলার কার্যক্রম বারংবার পুরাতন পথ ছাড়িয়া নূতন দিশা অনুসরণ করিবে, তাহা অস্বাভাবিক নহে। কিন্তু প্রয়োজনানুগ পরিবর্তন এক কথা, অব্যবস্থিতচিত্ততা সম্পূর্ণ ভিন্ন বস্তু। পশ্চিমবঙ্গে কোভিড ১৯-এর মোকাবিলায় রাজ্য সরকারের আচরণে দ্বিতীয়টির উপসর্গগুলি অতিমাত্রায় প্রবল। অতিমারির নূতন পর্বে রাজ্য প্রশাসনের নূতন নির্দেশিকা আরও এক বার তাহার সঙ্কেত দিয়াছে। সংক্রমণ বাড়িবে, এই সম্ভাবনা অজানা ছিল না। সেই বৃদ্ধি অভূতপূর্ব গতি অর্জন করিতে পারে, কয়েক সপ্তাহ যাবৎ নানা দেশের অভিজ্ঞতায় তাহারও প্রত্যক্ষ প্রমাণ মিলিতেছিল, দুনিয়ার বিশেষজ্ঞরাও এই বিষয়ে সতর্ক করিতেছিলেন। এই অবস্থায় রাজ্য সরকারের কর্তব্য ছিল জনসমাগম নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগী হওয়া। পশ্চিমবঙ্গের স্বভাবত বিশৃঙ্খল এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন নাগরিক পরিসরে কাজটি সহজ নহে, কিন্তু প্রশাসনের সদিচ্ছা থাকিলে অসম্ভবও নহে। অথচ রাজ্য সরকার ‘উৎসবের মরসুম’-এর মুখ চাহিয়া জনসমাগমের নিয়ন্ত্রণী বিধিগুলিকে আরও শিথিল করিয়া দিল। এবং সেই শিথিলতার সঙ্কেত নির্ভুল ভাবে পাঠ করিয়া অগণন নাগরিক বড়দিন ও ইংরেজি নববর্ষ পালনে বাঁধ ভাঙিয়া বাহির হইয়া পড়িলেন। তাহার পরিণাম গত কয়েক দিনের সংক্রমণের পরিসংখ্যানে সুস্পষ্ট। এই বিস্ফোরণের দায়ভাগ রাজ্য প্রশাসনের চালকরা অস্বীকার করিতে পারেন না। তাঁহারা উৎসবপ্রেমী সমাজকে খুশি রাখিতে গিয়া বৃহত্তর সমাজের বিপদ বহুগুণ বাড়াইয়া তুলিয়াছেন। অতঃপর, কলিকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের বীভৎস মজা সম্পন্ন হইলে, নিয়ন্ত্রণের নূতন তালিকা ঘোষণা করিলেন। তালিকাটি নূতন বটে, তবে নির্দেশিকাগুলি বহুলাংশেই পুরাতন, এবং অর্ধপক্ব, সঙ্গতিহীন ও প্রায়শই অযৌক্তিক, এমনকি বিপজ্জনক।
একটি বড় বিপদ অবশ্যই শিক্ষার। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পাইকারি ভাবে বন্ধ করিবার ঘোষণাটি কেবল দুই বৎসর যাবৎ স্তব্ধপ্রায় এবং দিশাহারা শিক্ষাব্যবস্থাকে নূতন করিয়া বিপন্ন করিল না, তাহা ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের মনে পঠনপাঠন সম্পর্কে নৈরাশ্য বহুগুণ বাড়াইয়া দিবে। অথচ গঙ্গাসাগর মেলার মতো একটি আয়োজনকে সরকার, অন্তত এখনও অবধি, ছাড়পত্র দিয়া রাখিয়াছে, যদিও সংক্রমণের বিপদ এমন জনারণ্যেই সর্বাধিক! ইহার পিছনে কি ‘সর্বভারতীয়’ জনপ্রিয়তার সুতীব্র বাসনা? ধর্মাশ্রিত রাজনীতির জটিলা কুটিলা মন্ত্রণার নিকট আত্মসমর্পণ? সংশয় অস্বাভাবিক নহে। তবে এই বিষয়ে কিছুমাত্র সংশয় থাকিতে পারে না যে, রাজ্য সরকারের কিছু বিধান সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। বিভিন্ন জনপরিসরে ভিড়ের মাত্রা অর্ধেক করিবার যে নির্দেশ, তাহা কার্যকর করা কেবল কঠিন নহে, অনেক ক্ষেত্রেই অসম্ভব, কারণ লোকাল ট্রেন, শপিং মল, বিবাহাদি সামাজিক অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে ‘পঞ্চাশ শতাংশ’-এর ধারণাটিই কার্যত অর্থহীন। সন্ধ্যা সাতটায় শেষ লোকাল ট্রেন ছাড়িবে— এমন বিচিত্র নীতি যে অতিমারি মোকাবিলার নামে অতিমারিতে ইন্ধন দিবার ব্যবস্থাপত্র, সেই সত্যটি প্রাজ্ঞ প্রশাসকরা দ্রুত বুঝিতে পারিয়াছেন, ভাল; তবে কিনা, এমন প্রাথমিক কাণ্ডজ্ঞানের কথা তাঁহারা নিজেরা ভাবিয়া উঠিতে পারেন নাই, চতুর্দিক হইতে তীব্র সমালোচনা শুনিয়া ও স্টেশনে স্টেশনে প্রবল ভিড় দেখিয়া তবে বুঝিলেন— দেখিয়া বিস্ময় হয়, ভয়ও। রাজ্যের অভিভাবকরা এতটাই দিশাহারা? এই সঙ্কটে প্রয়োজন ছিল যথার্থ নেতৃত্বের, যে নেতৃত্ব দাঁড়াইয়া থাকে পরিচ্ছন্ন বিচারবুদ্ধি এবং রাজনৈতিক প্রত্যয় ও সাহসের উপর, যাহা প্রকৃত জনস্বার্থের সুরক্ষাকে পাখির চোখ সাব্যস্ত করে এবং সেই লক্ষ্য পূরণের জন্য জনতার অপ্রিয় হইতেও কিছুমাত্র পিছপা হয় না। এই প্রাথমিক শর্ত পূরণে সরকার অনেকাংশেই ব্যর্থ।