প্রতীকী ছবি।
জানা কথা, সংখ্যার হিসাব মিলিবে না। মৃতদেহের সংখ্যা বাড়িলে বিরোধীদের লাভ, কমিলে শাসকের সুবিধা। সুতরাং, পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন-পরবর্তী হিংসায় যত নেতা-কর্মীর মৃত্যুর হিসাব বিজেপি পেশ করিতেছে, তাহার সহিত প্রশাসনের পেশ করা হিসাবের বিস্তর ফারাক। কোন সংখ্যাটি সত্য— বা সত্যের কাছাকাছি— সেই হিসাব কষিতে বসা অর্থহীন। ঘটনা হইল, বিধানসভা নির্বাচনের পরে এই রাজ্যে রাজনৈতিক হিংসার ঘটনা ঘটিয়াছে। এবং, ইহাও ঘটনা যে, এই গোত্রের হিংসায় শাসক দল অপেক্ষা বিরোধী দলের কর্মী-সমর্থকরাই সচরাচর বিপন্ন হন বেশি। রাজনৈতিক হিংসা পশ্চিমবঙ্গে নূতন নহে। অধুনা এই রাজ্যে ধর্ম বা জাতিগত পরিচিতির বিভাজনরেখাগুলি ক্রমশ প্রকট হইয়া উঠিলেও, এখনও, পশ্চিমবঙ্গের সমাজ মূলত রাজনৈতিক অক্ষে বিভক্ত। এই বিভাজিকাটিই প্রকটতম। ফলে, রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড় যাহাই বলুন না কেন, বর্তমান নির্বাচন-পরবর্তী হিংসাকে স্বাধীনতা-উত্তর পর্বে ‘অভূতপূর্ব’ বলিয়া চিহ্নিত করা মুশকিল। কিন্তু তাহার প্রয়োজনও নাই। বর্তমান হিংসা ঐতিহাসিক ভাবে কতখানি ভয়ঙ্কর, সেই তর্কে না ঢুকিয়াও বলা জরুরি— এই হিংসা নিন্দনীয়। এবং, তাহা ঠেকাইবার ব্যর্থতার দায়টি সম্পূর্ণত শাসক দলেরই। প্রশাসন যাহার হাতে, পুলিশ যাহার হাতে, হিংসা নিয়ন্ত্রণও তাহাদেরই দায়িত্ব। বর্তমান সরকার সেই দায়িত্ব পালনে সফল, গত দুই মাসের ঘটনায় এমন দাবি করিবার উপায় নাই। কিন্তু, পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাস সাক্ষী, ইহা এই রাজ্যের রাজনৈতিক ঐতিহ্যেরই অনুসারী। প্রশাসনের পক্ষপাত এই রাজ্যের দীর্ঘকালীন বাস্তব। বস্তুত, গোটা দেশের পক্ষেই কি কথাটি সত্য নহে?
কলিকাতা হাই কোর্ট যথার্থ ভাবেই এই প্রবণতাকে ভর্ৎসনা করিয়াছে। প্রশ্ন করিয়াছে, নির্বাচন-পরবর্তী হিংসা লইয়া এত লুকোছাপা কিসের? রাজ্যের আপত্তি অগ্রাহ্য করিয়াই আদালত জানাইয়াছে যে, কেন্দ্রীয় মানবাধিকার কমিশনের তত্ত্বাবধানে রাজ্যের নির্বাচন-পরবর্তী হিংসার ঘটনাবলির তদন্ত হইবে। এই পদক্ষেপকে স্বাগত। রাজ্যের শাসক দলের প্রতি রাজ্যের অধীন তদন্তকারী দলের পক্ষপাতের যে ধারা এই রাজ্যকে দুর্ভাগ্যক্রমে প্রত্যক্ষ করিতে হইয়াছে— শুধু বর্তমান জমানায় নহে, তাহার পূর্বসূরির আমলেও— সেই বিষচক্রকে ভাঙিবার ইহা প্রকৃষ্ট উপায় হইতে পারে। তদন্ত প্রয়োজন, অপরাধীদের চিহ্নিত করা প্রয়োজন; প্রশাসনের যে কর্তারা অন্যায় দেখিয়াও চক্ষু মুদিয়া ছিলেন, তাঁহাদেরও দোষ প্রকাশ্যে আসা জরুরি। রাজ্য সরকারের অধীন তদন্তকারী দল যাহা করিতে অক্ষম, মানবাধিকার কমিশনের তদন্তে তাহা সম্ভব হইতে পারে।
কিন্তু, তাহা আদৌ হইবে কি না, সে বিষয়ে সংশয় বিস্তর। এক বিপরীত পক্ষপাতের সংশয়। পশ্চিমবঙ্গের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি কেন্দ্রীয় শাসক। আদালতের নির্দেশে তাহারা উচ্ছ্বসিত হইতেই পারে— রাজ্যেও, দিল্লিতেও। কিন্তু, সেই উচ্ছ্বাসের ছটা কেন্দ্রীয় প্রশাসনের গায়েও লাগিবে, এমন আশঙ্কা প্রবল। সিবিআই বা ইডি-র ন্যায় তথাকথিত স্বনিয়ন্ত্রিত সংস্থাকে কেন্দ্রীয় সরকার গত সাত বৎসরে বিরোধীদমনের প্রধানতম হাতিয়ার করিয়া তুলিয়াছে। এই তদন্তেও যে সেই একই ঘটনা ঘটিবে না, তাহার নিশ্চয়তা নাই। রাজ্যপালও যে ভাবে নিজের পদমর্যাদা ভুলিয়া বিজেপি-নেতার ন্যায় আচরণ করিতেছেন, যে ভঙ্গিতে ‘উপদ্রুত’ অঞ্চলে ছুটিয়া যাইতেছেন, সংবাদমাধ্যমের নিকট রাজ্য সরকারের প্রতি বিরোধ প্রকাশ করিতেছেন, তাহা যদি কোনও সূচক হয়, তবে স্পষ্টতই, কেন্দ্রীয় সরকারও তদন্তে নিরপেক্ষতা বজায় রাখিতে আগ্রহী নহে। এক পক্ষপাতের ঔষধ যে বিপরীত পক্ষপাত হইতে পারে না, এই কথাটি ভুলিলে রাজ্যের ক্ষতি।