পরীক্ষা পরিচালনার ক্ষেত্রে এক ভয়ঙ্কর অ-প্রস্তুতির নিদর্শন।
ঘোষিত প্রতিশ্রুতি ছিল, সমগ্র দেশে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রক্রিয়াকে সহজতর করে ছাত্রছাত্রীদের উদ্বেগ দূর করা। কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, অভিন্ন প্রবেশিকা পরীক্ষা বা সিইউইটি নানাবিধ প্রযুক্তি সংক্রান্ত গোলযোগে স্বয়ং উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে ছাত্রছাত্রীদের কাছে। বলা হয়েছিল, স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের পড়ুয়াদের দেশের কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে যে কোনও বিষয় নিয়ে পড়ার সুযোগ মিলবে এক অভিন্ন প্রবেশিকা চালু হলে। দেশের যে কোনও প্রান্তের এক জন পড়ুয়া সম্পূর্ণ অন্য প্রান্তের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাবে। অথচ বাস্তবে দেখা গেল, পরীক্ষা পরিচালনার ক্ষেত্রেই এক ভয়ঙ্কর অ-প্রস্তুতির নিদর্শন। ফলত, পরীক্ষা শেষ হওয়া থেকে ভর্তি— সমগ্র প্রক্রিয়াটিতে কত সময় লাগবে, এখনও অস্পষ্ট। প্রশ্ন তোলা যায়, ১৪ লক্ষের অধিক পরীক্ষার্থীর ভবিষ্যতের ক্ষেত্রে এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ কেন?
বস্তুত, অভিন্ন প্রবেশিকা চালুর ভাবনাটিতেই একটা মস্ত গলদ রয়েছে। ভারতের মতো বিশাল দেশের পাঠ্যক্রম সর্বত্র সমান নয়। সেখানে একটিমাত্র পরীক্ষার মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের মূল্যায়ন অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত। তৎসত্ত্বেও যে তা নেওয়া হল, তার পিছনে বিকেন্দ্রীকরণের ধারাটিকে মুছে দিয়ে এক ধরনের ‘একত্ব’ চালুর প্রচেষ্টা স্পষ্ট। এই ভাবনা কেন্দ্রের ঘোষিত ‘এক দেশ এক পরীক্ষা’ নীতির বাস্তবায়ন, যে নীতির মাধ্যমে শিক্ষার গৈরিকীকরণ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির নিজস্বতা ও স্বাধিকার হরণের অভিযোগ ইতিমধ্যেই উঠেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বশাসনের অধিকারটি শিক্ষার পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ। তাকে হরণের চেষ্টা ঘোর অন্যায়। একই সঙ্গে, এই পদক্ষেপ শিক্ষাক্ষেত্রে রাজ্যগুলির সংবিধানপ্রদত্ত অধিকার কেড়ে নেওয়ারও এক নির্লজ্জ প্রচেষ্টা। শিক্ষা কেন্দ্র, রাজ্য যৌথ অধিকারভুক্ত হলেও যে ভাবে ইউজিসি রাজ্যকে এড়িয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিরোধী। পশ্চিমবঙ্গ, কেরল-সহ বিরোধী রাজ্যগুলির আপত্তি এইখানেই। যদিও দেশের বৈচিত্রকে অগ্রাহ্য করে ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, রীতিনীতির ক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদী সরকার যে ভাবে কেন্দ্রীকরণের রাস্তায় হেঁটেছে, তাতে শিক্ষায় এ-হেন পদক্ষেপে বিস্ময় জাগে না।
নীতিগত ত্রুটির পাশাপাশি গলদ রয়েছে পরীক্ষা পরিচালনা ব্যবস্থাটিতেও। সার্ভারের সমস্যা, অ্যাডমিশন কার্ডে বিলম্ব ও পরীক্ষাকেন্দ্র নিয়ে অস্পষ্টতা— অব্যবস্থা সর্বক্ষেত্রে। ফলত, ২০ অগস্টের মধ্যে পরীক্ষা সমাপ্ত করার কথা থাকলেও তা ২৮ অগস্ট অবধি পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। শেষ মুহূর্তে পরীক্ষাকেন্দ্রের পরিবর্তন, এমনকি একাধিক পরীক্ষা বাতিলের ঘটনাও ঘটেছে। ফলে, ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে কলেজে ভর্তির প্রক্রিয়াটি বিলম্বিত হওয়ার সম্ভাবনা। পড়ুয়াদের ভবিষ্যতের প্রশ্ন যেখানে, সেখানে কেন সময় নিয়ে আরও প্রস্তুত হয়ে, পরিকাঠামোগত উন্নতি ঘটিয়ে এই পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হল না? অতিমারিতে গত দু’বছর পঠনপাঠন এবং শিক্ষাবর্ষের সমূহ ক্ষতি হয়েছে। যখন স্বাভাবিক পঠনপাঠন এবং প্রচলিত পরীক্ষাগুলি সবেমাত্র চালু হয়েছে, ঠিক সেই সময়ই এই সম্পূর্ণ নতুন ব্যবস্থা চালুর সিদ্ধান্ত এবং তৎসংক্রান্ত নানা জটিলতার কারণে পড়ুয়াদের যে ভাবে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেওয়া হল, তার দায় কে নেবে?