কালীঘাট মন্দির। —ফাইল চিত্র।
কালীক্ষেত্রে আজ আলোর উৎসব, নিজের ঐতিহ্য ও উৎসকে ফিরে দেখার মাহেন্দ্রক্ষণ। কালীক্ষেত্র মানে যে কালীঘাট, সকলেই জানেন। কিন্তু এই অর্থ এক দিনে দাঁড়ায়নি। ১৮৭৩ সালে ইন্ডিয়ান অ্যান্টিকোয়ারি পত্রিকায় পদ্মনাভ ঘোষাল লিখেছিলেন, বেহালা থেকে দক্ষিণেশ্বর অবধি বিস্তৃত কলকাতা অতি প্রাচীন শহর। সতীর দেহাংশ এখানে পড়েছিল, তাই এই অঞ্চল কালীক্ষেত্র নামে খ্যাত। কলকাতা নামটি এই কালীক্ষেত্রের অপভ্রংশ। ঠিক কোন জায়গায় সতীর দেহাংশ পড়েছিল, পদ্মনাভ জানাননি। ১৮৯১ সালে মাইকেল মধুসূদন দত্তের হিন্দু কলেজের সহপাঠী গৌরদাস বসাক আবার লন্ডন, বস্টন ও কলকাতা থেকে প্রকাশিত দ্য ক্যালকাটা রিভিউ-তে জানাচ্ছেন, কালীঘাটই কালীক্ষেত্র। নবাব মহব্বত খান দেবীর সেবার জন্য কলকাতা গ্রামের কিছু জমি দান করেন। সেখান থেকেই শহরের নাম। তাই ১৮৪১ সালের বেঙ্গল অ্যান্ড আগরা গেজ়েটিয়ার-এও দেবী কালীকে উৎসর্গীকৃত গ্রামের নাম কলকাতা। বস্তুত, অন্য এক কাহিনিতে পলাশির যুদ্ধের ঢের আগে নবাব আলিবর্দি খান ও নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় এক দিন নৌকা সফরে বেরিয়েছেন, সন্ধ্যাবেলায় দেখলেন, জঙ্গলের মাঝে ছোট্ট কুটিরে এক সাধু প্রদীপ জ্বালিয়ে কালীমূর্তির পুজোয় ব্যস্ত। দেবীসেবার জন্য নবাব সেই সাধুকে জমি দান করলেন। কালীঘাটের মন্দির সংক্রান্ত ইতিকথার সামনে বাঙালির হিন্দু বনাম মুসলমান দ্বৈরথের অর্বাচীন প্রকল্প দাঁড়াতে পারবে না।
দাঁড়াতে পারবে না আরও অনেক বিভেদ বিভাজন। কালীঘাটে দক্ষিণেশ্বরের মতো পঞ্চবটী নেই। বরং নাটমন্দিরের অদূরে আছে ষষ্ঠীতলা। পাশাপাশি দু’টি বেদি, একটি মা ষষ্ঠীর, অন্যটি মনসার। দু’টিই নাকি বৈদান্তিক দশনামী সম্প্রদায়ের দুই সন্ন্যাসীর সমাধিবেদি। একটি চৌরঙ্গি গিরির, অন্যটি জঙ্গল গিরির। গৌরদাস বসাক জানাচ্ছেন, চৌরঙ্গি গিরি কালীপ্রতিমা আবিষ্কার করে শিষ্য জঙ্গল গিরির হাতে সেবার দায়িত্ব দিয়ে গঙ্গাসাগর চলে যান। তাঁর নামেই আজকের চৌরঙ্গি এলাকা। কালীমন্দিরের পুরাকথায় জড়িয়ে থাকলেন দুই বৈদান্তিক সন্ন্যাসীও। এবং সেখানেই শেষ নয়। অধুনা ষষ্ঠী ও মনসা নামের দুই লৌকিক দেবীর থানে পরিবর্তিত তাঁরা। নাটমন্দিরের পিছনেই রাধাকৃষ্ণ মন্দির। ১৮৪৩ সালে তৈরি সেই মন্দিরে আলাদা রান্নাঘরে রোজ নিরামিষ ভোগ রান্না। আবার, ভক্তরা বলিপ্রদত্ত ছাগ বা মেষ নিয়ে হাড়িকাঠতলায় আসেন। দিনের প্রথম বলির মুণ্ড ও কিছু অংশ যায় দুপুরে মা কালীর ভোগ হিসাবে। কোনও সম্প্রদায়গত বিভেদ না রেখে একই মন্দির চত্বরে কালী ও রাধাকৃষ্ণ— এখানেই কালীঘাটের দৈবী মাহাত্ম্য। আজও ভিখারি, যৌনকর্মী, পটুয়াপাড়া বেয়ে মন্দিরের অদূরে সন্ত টেরিজ়ার আশ্রম, চেতলায় মসজিদ, ট্রাম রাস্তা পেরিয়ে গ্রিক অর্থোডক্স গির্জা, রাসবিহারী মোড়ে শিখ গুরুদ্বার, সব মিলিয়ে এই এলাকা প্রায় ক্ষুদ্র ভারত।
কলকাতার জন্মকাহিনিতে কালীক্ষেত্র কালীঘাটের মহিমা ব্রিটিশরা মানবেন কেন? তাঁরা যখন তাঁদের প্রিয় বাণিজ্যনগরী নিয়ে লিখতে বসলেন, সেই সব লেখায় শুধুই জোব চার্নকের স্তুতি। তার আগে কলকাতা নাকি জনমানবহীন অস্বাস্থ্যকর জলা জমি ছিল, কোনও মন্দিরের উল্লেখও তাঁদের লেখায় নেই। ইংরেজি-শিক্ষিত গৌরদাস বসাক, অতুলকৃষ্ণ রায়, প্রাণকৃষ্ণ দত্তরা তখনই কালীঘাট-মাহাত্ম্য লিখতে শুরু করলেন। চার্নক ও ইংরেজের অবদান তাঁরা অস্বীকার করলেন না, কিন্তু কালীঘাট যে ঢের আগে থেকে পুণ্যক্ষেত্র, সেটিই তাঁদের প্রতিপাদ্য। ইংরেজি-শিক্ষিত নব্য ভদ্রলোকেরা মন্দিরকে প্রাধান্য দিলেন ঠিকই, কিন্তু অতুলকৃষ্ণ রায় ও প্রাণকৃষ্ণ দত্তের কালীকাহিনি শুরু হল কলকাতার ভূতাত্ত্বিক গড়ন দিয়ে। নেটিভ শহরের প্রান্তে অবস্থিত মন্দির, অথচ সবাই লিখছেন, কালীক্ষেত্রকে কেন্দ্র করেই শহর। অতঃপর কেউ লিখলেন, এখানে বল্লাল সেনের আমল থেকে জনবসতি। গৌরদাস বসাক জানালেন, এত প্রাচীন নয়, জনবসতির সূত্রপাত শেঠ, বসাকদের আমল থেকে। সূর্যকুমার হালদার আবার তাঁর পূর্বপুরুষদের কথা বলতে গিয়ে কালীক্ষেত্র-দীপিকায় লিখছেন, নবাব আলিবর্দি খান সেনাবাহিনীর হিন্দু হাবিলদারদের ‘হালদার’ পদবিতে ভূষিত করে কালীঘাটে জমিজিরেত দিতেন। তাঁরাই আজকের হালদার সেবায়তদের পূর্বসূরি। হিন্দু মন্দির-কেন্দ্রিক নব্য জাতীয়তাও সে দিন হিন্দু-মুসলমানে বিভেদ করেনি। কোন কাহিনির কতখানি প্রামাণ্য, কতটা নয়, সে অন্য তর্ক। কিন্তু একটা কথা পরিষ্কার। কালীঘাটের মজ্জায় হরেক বিভেদকে তুচ্ছ করে দেওয়ার ঐতিহ্য অন্তঃসলিলা হয়ে আছে। জরুরি ঐতিহ্য।