গতিই কি তা হলে দুর্গতির কারণ? না কি, লজ্ঝড়ে পুরনো বাসের অধিকতর পুরনো যন্ত্রাংশ বিগড়ে গিয়েই কাজের দিনের ব্যস্ত সকালে বেহালায় বেসরকারি বাস ধাক্কা মারল অন্য তিনটি যানবাহনকে, আবাসনের পাঁচিলে ধাক্কা মেরে ভেঙে দিল তার ফটক? পুলিশের তদন্ত ও পরীক্ষা চলছে, কিন্তু যে প্রশ্নটি কলকাতার পথে বাস ও দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে বার বার উঠে আসে, এ বারও এসেছে, তার উত্তর কোথায়? আর কবে এ শহরের গণপরিবহণ ব্যবস্থা সুষ্ঠু, স্বাভাবিক হবে? জুন মাসের শেষ পনেরো দিনে শহরে প্রাণঘাতী বাস দুর্ঘটনা হয়েছে চারটি, মারা গিয়েছেন পাঁচ নাগরিক। জুলাইয়ের শুরুতেই এ পি সি রোডে দু’টি বাসের গতির রেষারেষিতে দুর্ঘটনায় পাঁচ জন আহত হন, বেহালার দুর্ঘটনাতেও তারই পুনরাবৃত্তি। সৌভাগ্য যে কোনও প্রাণ চলে যায়নি, কিন্তু এ-ই কি শহরবাসীর ভবিতব্য: প্রাণ হাতে করে, ভাগ্যের হাতে জীবন ছেড়ে দিয়ে রোজ বাসে করে যাতায়াত?
কলকাতার রাস্তায় গণপরিবহণের, বিশেষত বেসরকারি বাসগুলির যা দশা, তাতে রোজ দুর্ঘটনার খবর না আসাই বরং অস্বাভাবিক মনে হয়। প্রায় প্রতিটি দুর্ঘটনার পরে জানা যায়, জড়িত বাসটির ফিটনেস সার্টিফিকেট ছিল না, স্পিডোমিটারের তার খোলা বা অকেজো, বাসচালক লাইসেন্সহীন, কিংবা ইদানীং কালের সবচেয়ে আতঙ্কের ব্যাপার: বাস চলছে ‘রিসোল টায়ার’-এ, দীর্ঘ দিন ব্যবহার হতে থাকা চাকা বদলানোর পরিবর্তে অনেক কম খরচে এক ধরনের পুরনো চাকার আস্তরণ লাগিয়ে! বাসচালক বা মালিকেরা জানাচ্ছেন যে, তাঁদের পুরনো বাস যথাযথ সংস্কারের অর্থ নেই, অনেক সময় পরিকাঠামোও মেলে না। অতিমারির বিগত দু’টি বছরে গণপরিবহণ, বিশেষত বেসরকারি বাসের পরিষেবা স্তব্ধ ছিল, পরে অবস্থা স্বাভাবিক হতে সরকারের উদ্যোগে পথে বাস নামানো হয়েছে ঠিকই, কিন্তু বাসভাড়া বৃদ্ধি বা তার স্বাভাবিকীকরণ পর্যন্ত হয়নি; বিমার টাকা মেটানো বা ফিটনেস সার্টিফিকেট করানোর খরচ মালিকেরা পাবেন কোথা থেকে? ফল যা হওয়ার তা-ই হয়েছে: ধুঁকতে থাকা চাকা ও যন্ত্রাংশ নিয়েই ঝুঁকির যাত্রা, এবং দুর্ঘটনা। সমগ্র প্রক্রিয়াটিতে রাজ্য সরকার দায় এড়াতে পারে না। বেসরকারি বাসের সুষ্ঠু পরিবহণে প্রথম ও প্রধান প্রতিবন্ধকতাটি আর্থিক, সরকার তা দেখবে না কেন? নাগরিক পরিষেবা নিশ্চিত করতেই তো বেসরকারি বাস মালিক সংগঠনের সঙ্গে নিয়ম করে আলোচনা ও পদক্ষেপ জরুরি!
দ্বিতীয় যে দিকটি একই রকম জরুরি, তা হল নজরদারি। বেহালার বাসটি যে ২৭১টি ‘কেস’ মাথায় নিয়েও পথে ছুটছিল, তা-ই প্রমাণ: সরকার ও পুলিশের নজরদারিতে বিস্তর ফাঁক আছে। এ এক প্রকাশ্য গোপন: ‘অভিজ্ঞ’জন মাত্রেই জানেন— মহানগরের রাস্তায় গতি তুলে, সিগন্যাল ভেঙে বা অন্য ভুল করেও পথপ্রহরীর হাতে ‘কিছু’ গুঁজে দিয়ে পার পেয়ে যাওয়া যায়, কিংবা শয়ে শয়ে কেস থাকলেও ফের দুর্বার গতিতে রাজপথে ছুটতে বাসের অসুবিধা হয় না। ভুক্তভোগী হন সাধারণ যাত্রী তথা নাগরিক, মৃত্যু বা গুরুতর আঘাতের মূল্যে। দুর্ঘটনার পর বাসচালকই ‘ভিলেন’ বনে যান, বেহালার বাসচালককেও গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু সরকারের চরম আর্থিক অবহেলা, বাস মালিকদের গয়ংগচ্ছ উদাসীনতা, পুলিশি নজরদারির প্রকট গাফিলতি— এর সুরাহা কবে হবে? পরবর্তী দুর্ঘটনারও পরে?