বছর পুরতে এখনও এক মাস বাকি, ইতিমধ্যে চলতি বছরে মাওবাদী নিধনের সরকারি হিসাব দাঁড়িয়েছে, ২০৭। ২০০৯ সালের পর এক বছরে এত মাওবাদী বিনাশের দৃষ্টান্ত আর নেই। ছত্তীসগঢ়, তেলঙ্গানা, কর্নাটক, বিভিন্ন রাজ্যের বহু জায়গা থেকে মাওবাদী বিতাড়ন ও নিধনের সংবাদ আসছে। মাওবাদী-উপদ্রুত অঞ্চলে তল্লাশির ফলে অজস্র পরিমাণ রাইফেল, যার মধ্যে একে-৪৭ থেকে এসএলআর সবই আছে, এবং আরও বহু অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। ছত্তীসগঢ়ের মুখ্যমন্ত্রী বিষ্ণু দেও সাই সরকারের ‘জ়িরো টলারেন্স’ বিষয়ে গৌরব প্রকাশ করেছেন। স্পষ্টতই মাওবাদী আতঙ্ক নির্মূল করার কার্যক্রমে আপাতত বিরাট সাফল্য দাবি করা যায়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ নিজেই সেই দাবি করতে পারেন, কেননা তিনি এই কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন, পূর্বতন ইউপিএ জমানায় যেমন করেছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম।
বাস্তবিক, এই সাফল্যের গুরুত্বকে কমিয়ে দেখা অসম্ভব। অনেকগুলি দশক জুড়ে মাওবাদী সন্ত্রাসের আতঙ্ক দেশের অনেকগুলি রাজ্যে বহু অরাজকতার কারণ হয়েছে। সেনা থেকে পুলিশ, এবং সাধারণ মানুষ— অসংখ্য প্রাণ চলে গিয়েছে ভয়াল অতর্কিত আক্রমণে। গ্রামবাসীদের উপর আক্রমণ নেমে এসেছে তাঁরা সরকারকে তথ্যহদিস দিয়ে সহায়তা করছেন, এই অনুমানে। এমনকি ২০২৪ সালেও তেলঙ্গানা রাজ্যে কোঠাগুদাম আঞ্চলিক কমিটি জঙ্গলাঞ্চলে রাজ করেছে এবং নিয়মিত ভাবে পার্শ্ববর্তী এলাকার কৃষক, শ্রমিক, ছোট বা মাঝারি ব্যবসায়ী, ঠিকাদার গোত্রের মানুষদের প্রাণনাশ ও বাড়ি-সম্পত্তি বিনাশের হুমকি দিয়ে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। বিষয়টি উল্লেখযোগ্য, কেননা ২০১৪ সালে তেলঙ্গানা রাজ্য তৈরি হওয়ার পর আলাদা গুরুত্ব দিয়ে এই রাজ্যের মাওবাদী এলাকাগুলিতে চিরুনি তল্লাশি চালানো হয়েছিল। একই রকম অভিযান ঘটেছিল ছত্তীসগঢ়েও। বহুলাংশে সাফল্য মেলার পরও যে আতঙ্ক-পরিবেশ হটানো যায়নি, গত দুই বছরের ঘটনাক্রমেই তা পরিষ্কার। জঙ্গল-পাহাড়ের ভূপ্রাকৃতিক পরিবেশ তাদের গোপন থাকতে ও সরকারি বাহিনীর দৃষ্টি এড়িয়ে চলতে সাহায্য করে বরাবর। এ এক সুদীর্ঘ লড়াই, রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্র-অবিশ্বাসী সমাজের। অসম লড়াইও বটে। রাষ্ট্রের জয় নিশ্চিত বটে, তবু বুঝতে অসুবিধা হয় না, দীর্ঘকালীন সশস্ত্র লড়াইয়ের ফলে যে বিপুল আতঙ্ক ও রক্তপাত ঘটেছে, যে কোনও গণতান্ত্রিক শাসকের পক্ষেই তা কত বড় উদ্বেগের কারণ হওয়ার কথা।
প্রশ্ন হল, দীর্ঘকালীন সঙ্কটের সামনে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রের এই যে সাফল্য, একে কি স্থায়ী বলা যায়? কিংবা, নিদেনপক্ষে, দীর্ঘমেয়াদি বলা যায়? বেশ কিছু দিন শান্তি বজায় রাখার পক্ষে এ কি যথেষ্ট? উত্তরটি যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক হবে না বলেই সন্দেহ। প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নতুন খনি এবং তৎসংক্রান্ত শিল্পায়নের যে রাষ্ট্রীয় অত্যাগ্রহ, তার সামনে দাঁড়িয়ে বন-বাসী সমাজের প্রতিরোধকে শূন্যে নামিয়ে আনার জন্য এই সব চিরুনি তল্লাশির সাফল্য কতটা স্থায়ী হতে পারে? কিছু কাল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকার পর হয়তো আবার প্রতিরোধী সন্ত্রাস মাথা চাড়া দেবে। প্রশ্নটিকে নিন্দকের ভ্রুকুঞ্চন ভেবে সরিয়ে না রেখে বাস্তবোচিত আলাপ-আলোচনা প্রয়োজন। ইতিপূর্বে বারংবার দেখা গিয়েছে, সাফল্য অর্জনের পর আবার পরিস্থিতি হয়ে দাঁড়িয়েছে যথাপূর্বম্।