সম্ভাবনাটির সলিতা পাকাইয়াছিলেন তিনিই। কেন্দ্রে বিজেপির ক্রমবর্ধমান একাধিপত্যকামী শাসনে সন্ত্রস্ত নাগরিকদের মনে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা আশার সঞ্চার করিয়াছিল। নাগরিক ভাবিয়াছিলেন যে, গত চার দশকে যাহা হয় নাই, তাহা হয়তো এই বার সম্ভব হইবে— আঞ্চলিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে, দলীয় সঙ্কীর্ণতার গণ্ডি ছাড়াইয়া একটি প্রকৃত বিরোধী জোট। এই সম্পাদকীয় স্তম্ভেও সেই আশার কথা লেখা হইয়াছিল, শাসক অগণতন্ত্রের পথে চলিলে তাহাকে প্রতিহত করিবার সংগঠিত গণতান্ত্রিক রাজনীতি অপেক্ষা ইতিবাচক আর কিছু হইতে পারে না, এমন বলা হইয়াছিল (‘উদ্যোগপর্ব’, ২৮-৭)। স্বভাবতই বিজেপির বিরুদ্ধে লড়িতে বিরোধী দলগুলি আদৌ জোট বাঁধিবে কি না, সেই বিবেচনা তাহাদেরই। কিন্তু, জোটবদ্ধ ভাবে যদি লড়িতে হয়, তবে তাহার জন্য ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করিতেই হইবে— মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই কথাটিতে কোনও ভুল ছিল না। আশ্চর্য যে, সপ্তাহও কাটিল না, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী নিজেই নিজের কথার বিরুদ্ধাচার করিলেন। দিল্লিতে রাহুল গাঁধীর উদ্যোগে পেগাসাস-বিষয়ে বিরোধী দলগুলির যে বৈঠক হইল, তাহাতে তিনি অনুপস্থিত থাকিলেন। কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধীর সহিত অবশ্য সাক্ষাৎ করিলেন— সেই বৈঠকে রাহুল গাঁধীও উপস্থিত ছিলেন। তবে বিরোধী বৈঠকে তাঁহার অনুপস্থিতির কাঁটা সেই সাক্ষাৎ উপড়াইয়া ফেলিতে পারে না, স্বীকার করিতেই হইবে।
ঘটনাটিকে ‘বিচ্ছিন্ন’, ‘পূর্বাপর-পরম্পর্যাহীন’ বলিয়া অগ্রাহ্য করিবারও কোনও উপায় নাই। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই সেই উপায় রাখেন নাই। পূর্বেও বিরোধী জোটের ক্ষেত্রে এমন দেখা গিয়াছে, কংগ্রেস আহূত বৈঠক বা কর্মসূচিতে একাধিক বার তিনি যোগদান করেন নাই। কেন তিনি এমন করিয়াছেন, সেই কারণ অনুসন্ধান করিবার প্রয়োজন নাই। যাহা দৃশ্যমান, সেইটুকু বিচার করাই যথেষ্ট। অস্বীকার করা যায় না যে, কংগ্রেস সর্বভারতীয় রাজনীতিতে ‘স্বাভাবিক নেতা’ হইবার যোগ্যতা দল খোয়াইয়াছে— এখন তৃণমূল কংগ্রেসের ন্যায় আঞ্চলিক শক্তিকে তাহাদের প্রাপ্য গুরুত্ব দিতেই হইবে— কিন্তু, একই সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও কি বুঝিতে হইবে না যে, কোনও দল কোনও কর্মসূচির ডাক দিলেই জোটের পুরা নেতৃত্ব সেই দলের নেতার হাতে চলিয়া যায় না। বরং, সব দলকে যদি মিলিয়ামিশিয়া লড়িতে হয়, তবে প্রত্যেকের আহ্বানে বাকি সকলের অকুণ্ঠ যোগদানই একমাত্র পথ। কোনও দল যদি প্রতিটি ধাপেই ক্ষমতার তুল্যমূল্য হিসাব কষিতে বসে, তাহাতে জোট রাজনীতির মারাত্মক ক্ষতি। মূলত এই কারণেই এ দেশে জোট রাজনীতি স্থায়ী হয় নাই। এই কারণেই গত কয়েক বৎসরে কেন্দ্রীয় শাসক বিজেপির বিরুদ্ধে কার্যকর বিরোধী জোট গড়িয়া তোলা যায় নাই।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জোটের আর এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা এনসিপি-প্রধান শরদ পওয়ারের সঙ্গে সাক্ষাৎ না করিয়াই রাজ্যে ফিরিলেন। তাঁহার দল বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে নারাজ। কিন্তু, চাহিলে কেহ সর্বভারতীয় জোটে প্রাদেশিক রাজনীতির ওজন মাপিবার চেষ্টা হিসাবেও ইহাকে দেখিতে পারেন। অন্য দিকে, মহারাষ্ট্রের রাজনীতিতে কংগ্রেস ও এনসিপি-র মধ্যে যে চোরাস্রোত, সর্বভারতীয় জোটেও তাহার ছাপ। পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের গুরুত্ব অকিঞ্চিৎকর, ফলে তৃণমূলের সহিত কংগ্রেসের দ্বৈরথ সর্বভারতীয় গুরুত্বের হিস্যা লইয়া; এনসিপি-র সহিত প্রশ্নটি যুগপৎ রাজ্যে ও সর্বভারতীয় স্তরে গুরুত্বের। কিন্তু, বিজেপি-বিরোধী জোটের অবস্থান হইতে দেখিলে, দুইটি বিরোধই ক্ষুদ্র স্বার্থসঞ্জাত— জোটের বৃহত্তর উদ্দেশ্যের বিপ্রতীপ। আঞ্চলিক নেতাদের ভাবিতে হইবে, তাঁহারা আদৌ এই জোটটি চাহেন কি না। অহং এবং ক্ষুদ্রস্বার্থ সরাইয়া রাখিতে পারিবেন কি না।