এ বারের মনিটারি পলিসি রিভিউ ঘোষণা করার দিন রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর শক্তিকান্ত দাস একটি হাতির কথা বলেছেন। মূল্যস্ফীতির হাতি। শ্রীদাস বলেছেন, দু’বছর আগে হাতিটি একেবারে ঘরের মধ্যে ছিল, এখন তা জঙ্গলে ফেরত গিয়েছে। তাঁর আশা, আপাতত সে হাতি জঙ্গলেই থাকবে। তাঁর আশাবাদের বড় কারণ হল, দেশে ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির সূচক নিম্নমুখী হয়েছে। বর্তমান অর্থবর্ষের প্রথম তিন মাসে সূচকটি সাড়ে চার শতাংশের স্তরে থাকবে বলেই পূর্বাভাস মিলছে। মূল্যস্ফীতির হার নিম্নমুখী হওয়ার চেয়ে সুখবর খুব কমই আছে, ফলে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর তাতে উচ্ছ্বসিত হলে দোষ দেওয়া যায় না। তবে, উচ্ছ্বাসের মাত্রা সম্বন্ধে সতর্ক থাকা ভাল। ভারতের ভূতপূর্ব মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যন যেমন স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, টাকার মূল্যে জিডিপির থেকে প্রকৃত জিডিপি হিসাব করার ক্ষেত্রে ভারত জিডিপি ডিফ্লেটরের যে অঙ্কটি ব্যবহার করছে, তা অবিশ্বাস্য। জিডিপি ডিফ্লেটর হল অর্থব্যবস্থায় মূল্যস্ফীতির হারের সূচক— জিডিপির হিসাবে তাকে ধরা হয়েছে মাত্র দেড় শতাংশ। শ্রীসুব্রহ্মণ্যনের মতে, ভারতের ডিফ্লেটরে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত পেট্রোলিয়ামের দামের গুরুত্ব বিপুল— সেই দাম অনেকখানি কমে যাওয়ায় ডিফ্লেটরও কমেছে। কিন্তু, অর্থব্যবস্থায় প্রকৃত মূল্যস্ফীতির হার সাড়ে চার থেকে পাঁচ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের হিসাবও তেমন সংখ্যার দিকেই ইঙ্গিত করছে। এখানে একটি কথা মনে করিয়ে দেওয়া জরুরি— অর্থব্যবস্থার কিছু টেকনিক্যাল সূচককে রাজনীতির অস্ত্র বানিয়ে ফেললে বিপদ অনিবার্য। জিডিপির বৃদ্ধির হার যে সাধারণ মানুষের ভাল থাকার নির্ভুল সূচক নয়, সে কথাটি বিস্মৃত হওয়া চলে না।
গত মাসে ভারতে খুচরো মূল্যসূচকের নিরিখে বৃদ্ধির হার ছিল ৮.৮৫%। কিন্তু, সেই একই সময়কালে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৮.৫২%। নিত্যপ্রয়োজনীয় আনাজের মূল্যবৃদ্ধির হার ২৮.৩৪%, গরিব মানুষের প্রোটিনের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উৎস ডালের ক্ষেত্রে তা ছিল ১৭.৭১%। খাদ্যশস্যের মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৩৭%। তুলনায় মাছ-মাংসের মূল্যস্ফীতি ঘটেছে সাত শতাংশের কম হারে। অর্থাৎ, খাদ্যশস্যের দাম উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে তো বটেই, সেই বৃদ্ধির আঁচ সবচেয়ে বেশি পড়েছে গরিব মানুষের পাতে। খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি সব শ্রেণির মানুষের জীবনেই প্রভাব ফেলে, কিন্তু সেই প্রভাব তুলনায় বেশি আর্থিক ভাবে দুর্বলতর শ্রেণির মানুষের ক্ষেত্রে। আয় যত কমে, আয়ের তত বেশি অংশ ব্যয় হয় খাদ্যপণ্যের পিছনে। ফলে, খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ঘটলে অন্য কোনও খরচ কমিয়ে খাদ্যের পিছনে ব্যয়বরাদ্দ অপরিবর্তিত রাখার সামর্থ্য গরিব মানুষের কম। অতএব, মূল্যস্ফীতি ঘটলে তা সরাসরি প্রভাব ফেলে গরিব মানুষের পুষ্টির উপরে। সেই প্রভাবও সমসত্ত্ব নয়— মূল্যবৃদ্ধি ঘটলে মেয়েদের পুষ্টির উপরে তার প্রভাব অনুপাতের চেয়ে বেশি হারে পড়ে। অতএব, কোনও মাপকাঠিতেই খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ঘটনাটি অকিঞ্চিৎকর নয়।
শক্তিকান্ত দাস যে হাতির কথাটি বলেছেন, তার উৎস ইংরেজি বাগ্ধারা— যেখানে ‘এলিফ্যান্ট ইন দ্য রুম’ কথাটির অর্থ, কোনও পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বড় এবং অস্বস্তিকর প্রশ্ন। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি বিপজ্জনক স্তরে থাকলেও শ্রীদাসের মনে হয়েছে যে, মূল্যস্ফীতির হাতিটি জঙ্গলে ফেরত গিয়েছে। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের শীর্ষকর্তা হিসাবে তাঁর প্রধানতম দায়িত্ব হল, মূল্যস্ফীতির হারকে নিয়ন্ত্রণে রাখার মতো মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা। এমন পদে আসীন কোনও ব্যক্তির কাছে যদি খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতির সমস্যাটি যথেষ্ট উদ্বেগজনক বলে মনে না হয়, তা হলে সেটাই আসল উদ্বেগের কারণ। সাধারণ মানুষের আর্থিক অবস্থা নিয়ে সরকার এবং নীতিনির্ধারকরা যথেষ্ট ভাবিত নন, সে কথাটাই ঘরে বসে থাকা আসল হাতি নয় তো?