সংবাদমাধ্যম যে সমাজের দর্পণ, সেই পুরনো কথাটি অধুনা এই রাজ্যের নাগরিকরা বিশেষ ভাবে উপলব্ধি করছেন। সেই উপলব্ধি আনন্দময় নয়, আতঙ্কজনক। কার্যত প্রতি দিন পত্রপত্রিকা, টেলিভিশন এবং অন্যান্য মাধ্যমের পাঠক-দর্শকদের সামনে উদ্ঘাটিত হয়ে চলেছে রাজ্যের নানা অঞ্চলে মেয়েদের উপর যৌন নির্যাতনের ধারাবিবরণী, অনেক ক্ষেত্রেই যে নির্যাতন ধর্ষণের রূপ নিচ্ছে, কোথাও কোথাও গণধর্ষণের। আর জি কর হাসপাতালের ভয়াবহ ধর্ষণ-খুনের পরে প্রায় তিন মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে অভূতপূর্ব প্রতিবাদ আন্দোলন এখনও জারি আছে। নিরন্তর উচ্চারিত হয়ে চলেছে এমন ঘটনা আর ঘটতে না দেওয়ার অঙ্গীকার। এবং, যেন সেই অঙ্গীকারকে বারংবার নিষ্ফল প্রমাণিত করেই, ঘটে চলেছে মেয়েদের শরীর ও মনকে ক্ষতবিক্ষত করার হিংস্র অভিযান। যে বা যারা আক্রমণ করছে তারা প্রায়শই আক্রান্ত মেয়েটির পরিচিত, কখনও প্রতিবেশী, কখনও বা ‘প্রেমিক’। অর্থাৎ, এই অদ্ভুত আঁধার বহিরাগত নয়, সমাজের অন্তর্গত।
এই পরিস্থিতি স্পষ্টতই সমাজের এক গভীর অসুস্থতার পরিচয় দেয়, যার মূলে আছে আর্থিক সঙ্কট, রাজনৈতিক হিংসা এবং শিক্ষা-সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের ত্র্যহস্পর্শ। জটিল ব্যাধির নিরাময়ের জন্য সমাজের দীর্ঘমেয়াদি এবং সার্বিক সংস্কার অবশ্যই জরুরি, কিন্তু তার অপেক্ষায় থাকা কোনও কাজের কাজ নয়। বাস্তববুদ্ধি দাবি করে যে মেয়েদের উপর আক্রমণের প্রবণতাকে দমন করতে প্রশাসন তার সর্বস্তরে, বিশেষত স্থানীয় স্তরে, তৎপর হবে। লোকদেখানো তৎপরতা নয়, সত্য অর্থে একশো শতাংশ তৎপরতা। অপরাধীদের শনাক্ত করা এবং অপরাধ প্রমাণের জন্য আবশ্যক কর্তব্যগুলি যুদ্ধকালীন উদ্যমে সম্পাদন করাই তার শর্ত। আক্ষরিক অর্থেই যুদ্ধকালীন, কারণ নারী-নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রশাসনের যুদ্ধ ঘোষণাই এখন জরুরি। পুলিশের কর্তা ও কর্মীরা এবং তাঁদের প্রশাসনিক তথা রাজনৈতিক চালকরা যদি চান, তবে এই যুদ্ধে সফল না হওয়ার কোনও কারণ নেই। রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে যারা ধর্ষণ বা অন্য নির্যাতনের ঘটনায় জড়িত, তারা সচরাচর স্থানীয় অধিবাসী বলেই তাদের চিহ্নিত করা এবং প্রয়োজনীয় সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করা তুলনায় সহজ হওয়ার কথা। প্রয়োজন উদ্যমের, প্রয়োজন সদিচ্ছার।
এখানেই সমস্যা। পুলিশ প্রশাসনের আচরণে নারী-নির্যাতনের ঘটনায় জড়িত অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার সদিচ্ছা এবং তৎপরতা সুলভ নয়। বিশেষত অপরাধীরা অনেক সময়েই স্থানীয় স্তরে নানা ধরনের প্রভাবশালী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকে, সেই সংযোগ প্রায়শই রাজনৈতিক দল অবধি প্রসারিত হয়। স্থানীয় পুলিশ এবং প্রশাসন সেই প্রভাব বা ক্ষমতার দ্বারা বহুলাংশে চালিত হয়। সামাজিক ক্ষোভ বা আদালতের নির্দেশ কখনও-কখনও পুলিশকে কাজে নামতে বাধ্য করে, যেমন অধুনা— জাগ্রত সামাজিক চেতনার কল্যাণে— কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে। কিন্তু যাঁরা প্রশাসনের নিয়ামক, সেই রাজনীতিকরা যদি নিজেদের সঙ্কীর্ণ স্বার্থকে আইন এবং নৈতিকতার উপরে স্থান দিয়ে চলেন এবং দুর্বৃত্তদের প্রশ্রয় দেওয়ার রীতিই চালিয়ে যান, তা হলে ধর্ষণের মতো অপরাধও প্রশ্রয় পাবেই। এই প্রতিকারহীন অপরাধের ধারাটি এত প্রবল বলেই সমাজের একটি বড় অংশের মধ্যে নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার প্রবণতাও দ্রুত বেড়ে চলেছে। সাম্প্রতিক নানা ঘটনায় দেখা গিয়েছে, ধর্ষণে অভিযুক্তদের পিটিয়ে মারার জন্য নাগরিকরা পুলিশের কাছে তীব্রস্বরে দাবি জানিয়েছেন। এবং, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে মন্ত্রী বা উচ্চপদাধিকারী দলনেতা অবধি রাজনীতিকরা অনেকেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে তাৎক্ষণিক ‘বিচার’-এর নামে প্রতিহিংসাকেই উচিত শাস্তি হিসাবে মর্যাদা দিচ্ছেন। এই নিরাবরণ জিঘাংসার উৎকট প্রচারের মধ্যেই ঘটে চলেছে ধর্ষণের অন্তহীন পরম্পরা।