রাহুল গান্ধী।
হেগেল এবং মার্ক্স, উভয় দার্শনিকই সম্ভবত একবিংশ শতকের কংগ্রেসের কথা আঁচ করতে পারেননি। পারলে, লেখার পাদটীকায় তাঁরা হয়তো উল্লেখ করতেন যে, কংগ্রেসের ক্ষেত্রে প্রথম বার যা ট্র্যাজেডি, প্রহসন হিসাবে তার পুনরাবৃত্তি চলতেই থাকবে। ট্র্যাজেডি হল, একদা ভারতের সমার্থক এই দলটিকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা নেহরু-গান্ধী পরিবারের আর নেই। এবং, প্রহসন হল, সেই ১৯৬৬ সাল থেকেই দল অন্য কারও হাতে নেতৃত্ব তুলে দিতে নারাজ। গত কয়েক বছরে রাহুল গান্ধী একাধিক বার নিজে দায়িত্ব ছাড়তে চেয়েছেন— এই বার তিনি জোর গলায় জানালেন, তাঁদের পরিবারের বাইরে কাউকে দলের নেতৃত্ব নিতে হবে; তিনি নিজেও সভাপতি হবেন না, তাঁর মা অথবা বোনকেও হতে দেবেন না। রাহুল কথাটি বলা ইস্তক প্রহসনের পুনরাবৃত্তি শুরু হয়েছে, দলের হরেক নেতা তাঁকেই সর্বোচ্চ পদে থেকে যাওয়ার জন্য সাধাসাধি করছেন, স্বয়ং সনিয়াও বোঝাচ্ছেন। দলটিকে তাঁরা কোন পরিণতিতে নিয়ে যেতে চান, সে সিদ্ধান্ত একান্ত ভাবেই তাঁদের, তবে ভারতীয় রাজনীতিতে যদি বিন্দুমাত্র গুরুত্বও বজায় রাখতে হয়, তা হলে এই বার তাঁরা নিজেদের পরিবারতন্ত্র থেকে মুক্ত করুন। রাহুল যথার্থই বলেছেন যে, তাঁর বা সনিয়ার নেতৃত্বে দল যে সফল হয়নি, নির্বাচনের ফলাফলই তার প্রমাণ। বস্তুত, কংগ্রেস আজ যে অতলে দাঁড়িয়েছে, তার থেকে খারাপ জায়গায় যাওয়া সত্যই কঠিন। এই মুহূর্তে কংগ্রেসের আর হারানোর কিছু নেই। এখনও যদি পরিবর্তনের সাহস না হয়, তবে আর কবে?
আদর্শ এবং আর্থ-সামাজিক নীতির কথা বিচার করলে কেউ— বিশেষত, এমন কেউ, ‘ভারত’ নামক বহুত্ববাদী, উদার ধারণাটির প্রতি যাঁর অন্তরের টান রয়েছে— কংগ্রেসকে দেশের অন্য দলগুলির চেয়ে অধিক গ্রহণযোগ্য ভাবলে আশ্চর্য হওয়ার কারণ নেই। তবুও কংগ্রেস এতখানি ক্ষীণবল হল কেন যে, বিরোধী জোটের প্রধান মুখ হিসাবেও এখন আর তাকে স্বীকার না করলে চলে? এই প্রশ্নের কোনও একটি নির্দিষ্ট উত্তর নেই, তবে দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা একটি বড় কারণ। দলের আদর্শকে সাধারণ মানুষের বোধগম্য ভাষায় এবং ভঙ্গিতে বলতে না পারা, সমাজমাধ্যমের পরিসরের বাইরে পা ফেলতে না পারা, কোনও একটি সুসংহত আন্দোলন তৈরি করতে না পারা, এ সবই কংগ্রেসের ব্যর্থতার কারণ। সেই দায় শীর্ষ নেতৃত্বের উপর বর্তায় বইকি। রাহুল গান্ধী যখন দায়টি স্বীকার করছেন, তখন অন্যরাও সেই সুযোগটি গ্রহণ করলে ভাল। কাজটি আগেই করা উচিত ছিল— ২০১৯-এর ব্যর্থতার পর, অথবা উত্তরপ্রদেশে ফের ভরাডুবির পর। অতি বিলম্বে করাও অবশ্য একেবারে না করার চেয়ে ভাল।
বুঝতে অসুবিধে নেই, রাহুল গান্ধী সরে গেলে সঙ্কটসাগরে ডুবতে বসবেন কংগ্রেসের সেই নেতারা, যাঁদের একমাত্র লক্ষ্য অন্য নেতাদের উন্নতিতে ক্রমাগত বাগড়া দেওয়া। ইতিহাস প্রমাণ, কংগ্রেসের গোষ্ঠীপতিরা পরস্পরের উন্নতি ঠেকাতে বারংবার গান্ধী পরিবারের আশ্রয় নিয়েছেন। ফলত বিশ শতকের শেষ ভাগ থেকেই এক দিকে অনিচ্ছুক ও অদক্ষ নেতৃত্ব নিয়ে চলতে হয়েছে কংগ্রেস দলটিকে, অন্য দিকে উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও সক্ষম নেতারা একে একে দল ছেড়েছেন। একুশ শতকের তৃতীয় দশকে এসে বিষয়টি প্রহসনের পর্যায়ে পৌঁছেছে। এই প্রহসন শেষ হওয়া দরকার, এখনই। হৃতগৌরব কংগ্রেসের অস্তিত্বরক্ষার দ্বিতীয় পথ নেই। শেষে আর একটি কথা। কেবল কংগ্রেস নয়, রাহুল গান্ধী নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ালে হয়তো বিপাকে পড়বে প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপিও, আক্রমণের মূল চাঁদমারিটিই তখন থাকবে না বলে! অবশ্য কংগ্রেসের বিবদমান নেতারাই ইত্যবসরে নতুনতর বিষয় এগিয়ে দেবেন প্রতিপক্ষের দিকে, এই ভরসা তাঁদের উপর করাই যায়!