Rabindranath Tagore

হাতে ও কলমে

রবীন্দ্রনাথ যে সাহিত্যচর্চা ছাড়া আরও অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ পথের পথিকৃৎ, ২৫ বৈশাখের ধূপধুনোর ভিতর থেকে তা খুঁজে বার করা দুরূহ।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৮ মে ২০২২ ০৪:৫৫
Share:

ফাইল চিত্র।

রবীন্দ্রনাথ যে সাহিত্যচর্চা ছাড়া আরও অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ পথের পথিকৃৎ, ২৫ বৈশাখের ধূপধুনোর ভিতর থেকে তা খুঁজে বার করা দুরূহ। তবু এ বছর তাঁর অন্যতম এক জরুরি কাজ শতবর্ষ পূর্ণ করল, ইত্যবসরে তা নিয়ে কথা হওয়া প্রয়োজন। ১৯২২ সালে শান্তিনিকেতন থেকে তিন কিলোমিটার দূরে সুরুলে পল্লি পুনর্গঠন কেন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। গ্রামবাসীদের সহায়তা করাই উদ্দেশ্য— বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া সমাধানের পথে না গিয়ে তাঁরা যেন নিজেরাই নিজেদের সমস্যা মেটাতে সমর্থ হন। রবীন্দ্রনাথের এ ভাবনার পূর্বসূত্র মিলবে চিঠিপত্রে— “যখন এ কথা কাউকে বলে কয়ে বোঝাতে পারলুম না যে, আমাদের স্বায়ত্তশাসনের ক্ষেত্র হচ্ছে কৃষিপল্লীতে... তখন কিছুক্ষণের জন্য কানে কলম গুঁজে এ কথা আমাকে বলতে হল— আচ্ছা, আমিই এ কাজে লাগব।” কানে কলম গোঁজা কথা নেহাত আলঙ্কারিক নয়, এক কালে সাহিত্যচর্চাকেই একমাত্র অভীষ্ট ভাবতেন রবীন্দ্রনাথ, লেখনী দিয়ে ভাবের খনি খনন করা ছাড়া নিজের আর যোগ্যতাও দেখতেন না। কিন্তু দেশগঠনে যখন প্রায় কোনও সঙ্গীই পেলেন না, তখন নিজেই হাত লাগালেন এই কাজে। এই দায়িত্বকে তিনি কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ভাবতেন তা বোঝা যায় কেন্দ্রের প্রথম অধিকর্তা লিয়োনার্ড এল্‌মহার্স্টকে লেখা এক চিঠিতে। কৃষির উন্নতিকল্পে ছাত্রদের মৃত্তিকা খননের কথা জানতে পেরে তাতে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আসলে, হাতে-কলমে শিক্ষাকে পুঁথিগত লেখাপড়ার চেয়ে কোনও অংশে কম বলে মনে করেননি তিনি।

Advertisement

পল্লি পুনর্গঠন কেন্দ্র শ্রীনিকেতন হল বিশ্বভারতীর দ্বিতীয় ক্যাম্পাস বা শিক্ষাপ্রাঙ্গণ। ১৯২৭-এ সেখানে স্থানান্তরিত হল শিক্ষাসত্র, ১৯৩৬-এ প্রতিষ্ঠিত হল লোক-শিক্ষা সংসদ, পরের বছর শিক্ষা-চর্চা। রবীন্দ্রনাথ মনে করেছিলেন, গ্রামজীবনের পুনর্গঠনে দরকার নতুন ধরনের বিদ্যালয়, যেখানে আশেপাশের গ্রামের পড়ুয়ারা লেখাপড়া করবে, এবং সংগৃহীত বিদ্যা পল্লি উন্নয়নের হাতিয়ার হয়ে উঠবে। শিক্ষার সুযোগ যাঁদের নেই, প্রথাগত পন্থার বাইরে তাঁদের লেখাপড়া শেখাবে সংসদ, আর শিক্ষা-চর্চা প্রশিক্ষণ দেবে গ্রামীণ শিক্ষকদের। ভাবনাটি গভীরতর— পল্লবগ্রাহী ও মুখস্থনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থায় যারা স্কুলে পড়ে ও পড়ে-না তাদের মধ্যে খুব সহজেই শিক্ষিত-অশিক্ষিত ভেদ তৈরি হয়ে যায়, এ ভাবেই পর্দা পড়ে যায় ‘চাষাভূষো’ মানুষের সামনে। রাজনীতির কথা বাদই রইল, হিতাকাঙ্ক্ষী সমাজকর্মীদের দৃষ্টিও যে সমাজের এই নীচের তলায় পৌঁছয় না, তার কারণ পুঁথি-পড়িয়েদের সঙ্গে অবশিষ্টাংশের এই বৈষম্য। চিন্তা করার সাহস অথবা কাজ করার দক্ষতা, কোনওটিই দিতে পারে না প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা, তাই তা যথার্থ কাজেও লাগে না। অথচ ভারতের প্রাণ গ্রামাঞ্চলে, পল্লিজীবনের উন্নতি না ঘটলে দেশের অগ্রবর্তী হওয়ার উপায় নেই, এ কথা একশো বছর পরেও সমান সত্য।

প্রসঙ্গত, অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীর পশ্চিমি চিন্তার ভুবনে অনেকেই দৈহিক ও মানসিক শ্রমের বিভাজনের সঙ্গে নগর ও পল্লির পার্থক্যের সাযুজ্য খুঁজেছিলেন। এই চিন্তাধারা অনুসরণ করলে বলা চলে যে, এই দুইয়ের দ্বন্দ্বেই আমরা পৌঁছেছি বর্বরতা থেকে সভ্যতায়, জনজাতি থেকে রাষ্ট্রে, অঞ্চল থেকে জাতিতে। অতএব, এই ফারাক সভ্যতার ইতিহাসের দর্পণবিশেষ। রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন, ‘কংগ্রেসের পান্‌ডালে এবং খবরের কাগজের প্রবন্ধশালায়’ শিক্ষিত সম্প্রদায়ের বেদনা ছাড়া কিছুই ঘোষিত হয় না, ‘কলমে-বাঁধা হাত’ দেশ গড়ে তোলার কাজে বিন্দুমাত্র এগোতে পারেনি, তখন উপরোক্ত চিন্তাধারার সঙ্গে তাঁর দেশগঠন ভাবনার কিছু কিছু সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথের মতো চিন্তকদের বিশিষ্টতা হল, তাঁরা শুধু আপন জ্ঞানালোকে দীপ্ত হয়ে উপলব্ধি প্রকাশ করেই থেমে যাননি, পথটি কেমন হতে পারে পথে নেমে তা খুঁজেছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সেই দীপ্তরশ্মি ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন, যার উত্তরাধিকার দেখা যায় এল্‌মহার্স্ট, কালীমোহন ঘোষ, ক্ষিতিমোহন সেনদের ভাবনায়, উদ্যোগে। আজকে ভারতে যখন গ্রাম-শহরের ফারাক ক্রমশ বেড়ে চলেছে— এক দিকে ঝাঁ-চকচকে উন্নয়নের জয়রথ ছুটছে, অন্য দিকে সড়ক-বিদ্যুৎ-জলের মতো প্রাথমিক পরিষেবাও অমিল— তখন পথ দেখাতে পারে বিদ্যাচর্চার এমন বিকল্প ভাবনাই। রবীন্দ্রনাথের শ্রীনিকেতন তাই বিংশ শতকের বাংলার ইতিহাসে এক জরুরি এবং অনন্য অভিজ্ঞতা।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement