মহিলা ও শিশুদের উপর অপরাধ সংক্রান্ত জাতীয় আইনের সংশোধনী প্রস্তাব পাশ করল পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করলেন, অপরাজিতা মহিলা ও শিশু (পশ্চিমবঙ্গ ফৌজদারি আইন সংশোধন) বিল ২০২৪, “ঐতিহাসিক”। ঠিক কী অর্থে ইতিহাস রচনা করল এই সংশোধনী প্রস্তাব? এর বিশেষত্ব নতুনত্বে নয়, বরং পুনরাবৃত্তিতে। সংসদীয় অ-গণতন্ত্রের যে খাতে গড়াচ্ছে ভারতের রাজনীতি, সেই পথ দিয়েই এল অপরাজিতা বিল, এবং মাত্র এক দিনে পাশও হয়ে গেল। যে কোনও আইন পাশ করার আগে সর্বসাধারণের কাছে তার খসড়া প্রকাশ করে মন্তব্য আহ্বান করা দীর্ঘ দিনের দস্তুর। এ ক্ষেত্রে দেখা গেল, যৌননিগ্রহ ও ধর্ষণের প্রতিরোধ ও প্রতিকার সংক্রান্ত আইন, যার তাৎপর্য বহুস্তরীয় এবং বহুমাত্রিক, তা নিয়ে আলোচনার কোনও সুযোগই মিলল না— না নাগরিক সমাজে, না আইনসভায়। এমনই বিতর্কহীন ভারতীয় গণতন্ত্রের সাম্প্রতিক ইতিহাস। আরও উদ্বেগজনক এই যে, অপরাধ ও ন্যায়বিচার সম্পর্কিত যে চিন্তাধারা শক্তিশালী হয়েছে ২০১২ সালে নির্ভয়া গণধর্ষণ কাণ্ডের পরে, এই সংশোধনী তার উপরেই কলম বোলাল। তা এই যে, শাস্তির কঠোরতা বাড়ালে অপরাধপ্রবণতা কমানো যায়। এর প্রভাবে ভারতীয় ন্যায় সংহিতায় (২০২৪) ধর্ষণ-সহ বিভিন্ন অপরাধের যে সব শাস্তির কথা উল্লেখ রয়েছে, রাজ্যের প্রস্তাবে তার প্রতিটির ক্ষেত্রেই ন্যূনতম শাস্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এই কঠোর মনোভাবের চূড়ান্ত প্রকাশ— ধর্ষণ ও হত্যার (বা আক্রান্ত জীবন্মৃত হওয়ার) অপরাধ সংক্রান্ত ধারায়, যেখানে ন্যূনতম শাস্তি প্রাণদণ্ড, জরিমানা-সহ।
মানবাধিকার কর্মীরা এবং সংবিধান বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে আইনি প্রশ্ন তুলবেন, তা প্রায় নিশ্চিত। প্রশ্ন তুলছেন সমাজকর্মী এবং আইনজীবীরাও। তাঁদের অভিজ্ঞতা, শাস্তির কঠোরতা বাড়লে দোষী সাব্যস্ত করার হার কমে। প্রাণদণ্ড কতটা ফলপ্রসূ, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। নির্ভয়া কাণ্ডের পরে বিচারপতি বর্মার নেতৃত্বে গঠিত কমিটি মত দিয়েছিল, প্রাণদণ্ড অপরাধ প্রতিরোধ করতে পারে না। ভারতীয় ন্যায় সংহিতা সেই সুপারিশ অগ্রাহ্য করেছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারও তা-ই করল। সুপ্রিম কোর্ট যেখানে ‘বিরলের মধ্যেও বিরলতম’ অপরাধ ছাড়া প্রাণদণ্ড দেয় না, সেখানে মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং জনসভায় ধর্ষকদের ফাঁসি দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করেছেন। অথচ, ফাঁসির দণ্ডের ব্যবস্থা জাতীয় আইনেও ছিল, সংশোধনের প্রয়োজন ছিল না। প্রশ্ন জাগে, আইনে বজ্র আঁটুনি কি আঁটা হল প্রশাসনের ফস্কা গেরো থেকে দৃষ্টি ফেরাতে? আর জি কর কাণ্ডের তদন্তে পুলিশের সন্দেহজনক, অপেশাদার কীর্তিকলাপের জন্য প্রবল জনরোষের মুখে সরকার। পুলিশ কমিশনারের পদত্যাগের দাবি উঠেছে। আদালতেও ভর্ৎসিত এ রাজ্য। এই বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে, হত্যাকাণ্ডের মাত্র চব্বিশ দিনের মাথায় বিধানসভার বিশেষ অধিবেশন ডেকে সংশোধনী পাশ করানোর তৎপরতা যেন আইন পালনে শিথিলতা ঢাকার চেষ্টা।
সংশোধনী প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ধর্ষণের মতো অপরাধের বিচারের জন্য প্রতি জেলায় স্পেশাল কোর্ট তৈরি হবে। এতে সামান্যই ভরসা জাগে, কারণ কেন্দ্রের হিসাবে এ রাজ্যে একশো তেইশটি ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট তৈরি হওয়া দরকার। উপরন্তু, রাজ্যে কর্মরত স্পেশাল কোর্টগুলি লোকবলের অভাবে এবং পরিকাঠামোর দুর্বলতায় শীর্ণ। সাধারণ আদালতের চাইতে সেগুলি বেশি কার্যক্ষম, এমন বলা চলে না। পুলিশের স্পেশাল টাস্ক ফোর্স তৈরি করা, একুশ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করার প্রস্তাবের ক্ষেত্রেও সংশয় একই— যথেষ্ট পুলিশকর্মী এবং অর্থ বরাদ্দ না থাকলে দ্রুত তদন্ত হবে না, বরং অভিযোগ নথিভুক্তিতেই অনাগ্রহ দেখা দেবে। এই ভয়ার্ত সময়ে সরকার ও প্রশাসনের প্রতি মেয়েদের আস্থা ফেরানোর জন্য বিধানসভায় পাশ-করানো প্রস্তাবটি সমস্যাজনক। কঠোর আইন নয়, চাই দুর্বৃত্তের প্রতি কঠোর প্রশাসন।