অধুনা ভারতীয় রাজনীতিকদের দিকে তাকালে বোঝা যায়, বিশ্বাসে মিলায় বক্তব্য, তর্কে বহু দূর। তর্ক কেবল গায়ের জোরে করার বস্তু নয়, এ এক শাস্ত্র। বিজেপি রাজনীতিকরা প্রাচীন ভারতে অগাধ আস্থা রাখেন, তর্কশাস্ত্র কিন্তু প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতারই অসামান্য অবদান। বিশ্বের সব প্রাচীন সভ্যতায় এই তর্ক-ঐতিহ্য না থাকলেও ভারতে ছিল। অমর্ত্য সেন এই ‘প্রাচীন ভারতপন্থী’দের চক্ষুশূল হলেও বিশদ ভাবে তিনিই এর পর্যালোচনা করেছেন। অধুনা অবশ্য ভারতীয় রাজনীতির প্রাচীনবাদীরা তর্ক বা যুক্তির দিকে না গিয়ে কেবল ‘বিশ্বাস’-এর উপর ভর করে কথা বলে যান, যে বিশ্বাস আবার চরিত্রগত ভাবে সীমিত, সঙ্কীর্ণ ও অসহিষ্ণু। উপরাষ্ট্রপতি এবং রাজ্যসভার প্রধান নেতা জগদীপ ধনখড় তা প্রমাণ করলেন, কথায় ও কাজে। উচ্চৈঃস্বরে দাবি করলেন যে যাঁরা সংসদে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সমালোচনা করছেন, তাঁরা মনে রাখছেন না যে ওই সংগঠন ভারতের ইতিহাসে সেবা ও আত্মত্যাগের জন্য স্মরণীয়, তাই তার বিষয়ে এমন কথা বলা অন্যায়, অসাংবিধানিক। শুনে খটকা লাগে। যদি বা ধরে নেওয়া যায় যে কোনও সংগঠন অতীতে বিশেষ কৃতিত্ব দাবি করার মতো কিছু কাজ করেছে, তবে কি বর্তমানে ও ভবিষ্যতে তার বিষয়ে কোনও সমালোচনাই করা যাবে না? কংগ্রেস বিষয়ে যখন বিজেপি নেতারা— বিশেষত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী— মাসের পর মাস, বছরের পর বছর নিন্দাবর্ষণ করেন, দেশকে কংগ্রেসমুক্ত করার জন্য জাতির প্রতি আহ্বান জানান, তখন তো এই আদর্শ তাঁরা মেনে চলেন না? না কি, তাঁদের মতে, দেশের প্রতি, জাতির প্রতি কর্তব্যকর্ম কেবল আরএসএস-ই করেছে, কংগ্রেস কিছুটি করেনি?
তর্কের দ্বিতীয় স্খলনটি আরও এক ধাপ গভীরে নিহিত। ইতিহাসের গভীরে। আরএসএস-কে দেশাত্মবোধের মানদণ্ডে অসামান্য দাবি করার পিছনে যে ইতিহাসজ্ঞানের আত্যন্তিক অভাব, তা অবশ্যই মাননীয় উপরাষ্ট্রপতির একার সমস্যা নয়, এ এক সুচিন্তিত সুসংগঠিত আরএসএস-বিজেপি কৌশল। ভারতীয় জনসাধারণকে ভুলিয়ে দেওয়ার কৌশল, কী ভাবে ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে আরএসএস বারংবার ব্রিটিশের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল, কী ভাবে প্রধান নেতা অনুনয় করে, দস্তখত লিখে জেল থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন যখন অন্যরা জীবন দিয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধের দাম দিচ্ছিলেন, কী ভাবে মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করার কলঙ্ক এই সংগঠন ‘অর্জন’ করেছিল। ধনখড় এবং তাঁর সতীর্থরা এর পরও মনে করতে পারেন যে আরএসএস এক ভিন্ন জাতীয়তার দর্শন অনুসরণ করেছে বলেই তাঁরা গর্বিত। কিন্তু অন্তত তর্ক ও যুক্তির স্বার্থে, তাঁদের এও মেনে নিতে হবে যে অন্যরা এই সংগঠনের সমালোচনা করার অধিকার রাখেন। ন্যায়ের স্বার্থে, ‘অপর’ মতামতকে এটুকু পরিসর তাঁদের দিতেই হবে। সেটা না দেওয়াটাই, বস্তুত, সংবিধান অমান্য করা।
অসাংবিধানিক, দায়িত্বজ্ঞানহীন কথা কেউ বলতেই পারেন, ধনখড় মহাশয়ের সেই ‘খ্যাতি’ অন্তত পশ্চিমবঙ্গবাসীর কাছে পূর্বজ্ঞাত। কিন্তু ঘটনা হল, তিনি আর এখন রাজনৈতিক নেতামাত্র নন, এমনকি রাজনীতিতে অমার্জনীয় রকম অত্যুৎসাহী রাজ্যপালও নন। তিনি এখন দেশের উপরাষ্ট্রপতির মতো সম্মানিত পদে অভিষিক্ত। এমন একটি পদ থেকে কাণ্ডজ্ঞানহীন বক্তব্য পেশ করছেন কেউ, তা সংসদীয় রাজনীতির বিষম দুর্ভাগ্য বলতে হবে। এখানেই শেষ নয়। বারংবার অমার্জিত আচরণে ও সাংসদদের প্রতি অভব্য আচরণেও তিনি অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠা করে চলেছেন। এখনকার জনপ্রতিনিধিদের থেকে ভদ্রতা ও সভ্যতা আশা করাই বাড়াবাড়ি, তবে এত গুরুত্বপূর্ণ একটি পদকেও যে সেই গোত্রে ফেলতে হচ্ছে, তা সংসদীয় গণতন্ত্রের দুর্ভাগ্যকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়। এই পদের দায়িত্ব তাঁকে দিয়ে পদটির ভূমিকা ও দায়িত্বকেই আসলে পাল্টাতে চাওয়া হচ্ছে, ধনখড় বুঝিয়ে দিচ্ছেন।