পথপার্শ্বের গাছ অপেক্ষা দুর্ভাগা বোধ হয় আর কেহ নাই। সামান্যতম অজুহাতে তাহাদের নির্বিচারে কাটিয়া ফেলা যায়, যখন খুশি অঙ্গচ্ছেদন করা যায়। নির্বাচন আসিলে তাহাদের দুর্ভোগ আরও বাড়ে। রাজনৈতিক দলের প্রচারাভিযানে তাহারা অন্যতম হাতিয়ার। তাহাদের শরীরে যথেচ্ছ পেরেক, গজাল, লোহার তার গাঁথিয়া ফ্লেক্স, ব্যানার টাঙাইয়া অত্যাচার করা চলে। গাছ দল বাঁধিয়া প্রতিবাদ, পথ অবরোধ করিতে পারে না। তাহাদের ভোটও নাই। তদুপরি, গাছ বাঁচাইয়া ব্যানার টাঙাইতে হইলে আলাদা কাঠামো গড়িতে হয়। তাহাতে খরচ বেশি। পশ্চিমবঙ্গ-সহ ভারতের অন্যত্র পরিবেশ-সচেতনতার যে অসাধারণ চিত্র নিয়মিত দেখা যায়, তাহাতে এই অতিরিক্ত খরচটুকুর পরিবর্তে ইট, হাতুড়ি, পেরেকের আশ্রয় লওয়াই সহজ এবং স্বাভাবিক। তাহাই হইতেছে।
রাজনৈতিক দলগুলির এহেন কাণ্ডজ্ঞানহীনতার প্রধান কারণ সরকারি উদাসীনতা এবং নীরব প্রশ্রয়। পরিবেশ সংরক্ষণ বলিতে যে শুধুমাত্র কিছু বৃক্ষরোপণ নহে, গাছগুলির রক্ষণাবেক্ষণও বুঝায়, সেই কথাটি সরকার এত দিনেও যথেষ্ট উপলব্ধি করিতে পারে নাই। তাই প্রতি বৎসর নিয়ম করিয়া বৃক্ষরোপণ হয়। অতঃপর সেই নূতন গাছগুলির কয়টি বাঁচিল, কয়টিকে গরু-ছাগলে খাইল, কয়টি অযত্নে মরিয়া গেল— সেই খবর কেহ রাখে না। গত বৎসর আমপানের পর কলিকাতায় অত্যধিক গাছ পড়িবার কারণ লইয়া রীতিমতো চর্চা হইয়াছিল। বিশেষজ্ঞরা জানাইয়াছিলেন, মাটির চরিত্র না বুঝিয়া অবৈজ্ঞানিক ভাবে বৃক্ষরোপণের মূল্য চুকাইয়াছে গাছগুলি। বৃহৎ গাছগুলির ক্ষেত্রেও শিকড় মাটির গভীরে প্রবেশ করিতে পারে না কংক্রিট, সিমেন্টের আধিক্যে। গোড়া মজবুত না হইবার কারণে আমপানের ন্যায় প্রবল ঝড় তো বটেই, সাধারণ কালবৈশাখী সহ্য করিবার ক্ষমতাও হারায় গাছগুলি। ইহা শুধুমাত্র কলিকাতার চিত্র নহে, গ্রাম, মফস্সলের চিত্রটিও অনুরূপ। যে গাছগুলি কোনও ক্রমে টিকিয়া যায়, তাহাদের নিয়মিত নানাবিধ অত্যাচার সহ্য করিতে হয়। কোথাও তাহাদের গোড়ায় সিমেন্ট ঢালিয়া বেদি নির্মাণ করিয়া সৌন্দর্যায়ন চলে, কোথাও প্রায় তাহাদের মধ্য দিয়াই বিদ্যুতের তার টানা হয়, উৎসবের দিনে কাণ্ড, শাখা-প্রশাখায় আলো জড়াইয়া দেওয়া হয়। গাছের ক্ষতি কতটা হইল, প্রশাসন হইতে সাধারণ মানুষ— কেহ ভাবে না।
অথচ, গাছের গোড়া বাঁধাইয়া সৌন্দর্যায়নের বিপজ্জনক পরিণতি লইয়া বহু বার রাজ্য প্রশাসনকে সতর্ক করা হইয়াছে। কাজ হয় নাই। হাই কোর্টের পক্ষ হইতে নির্দেশ দেওয়া হইয়াছিল, সমস্ত গাছের নীচের বেদি ভাঙিয়া ফেলিবার এবং গাছের পার্শ্বে কোনও বেআইনি নির্মাণ হইতেছে কি না, তাহাতে কড়া নজরদারি করিবার। সেই কাজ কত দূর অগ্রসর হইয়াছে? বহু স্থানে গাছের নীচেই মন্দির গড়িয়া উঠিয়াছে। নানাবিধ ক্ষতিকর সামগ্রী পড়িয়া গোড়াগুলির সমূহ ক্ষতি হইতেছে। কিন্তু ধর্ম ও রাজনীতি যুগপৎ সেই ক্ষতির প্রতি চোখ বুজিয়া থাকিবার কৌশল লইয়াছে। পরিবেশের প্রতি উদাসীন থাকিলে কী হইতে পারে, সাম্প্রতিক প্রাকৃতিক বিপর্যয়গুলি সেই সাক্ষ্য বহন করিতেছে। প্রশ্ন এখানে শুধুমাত্র একটি পেরেক পুঁতিবার নহে। সামগ্রিক ভাবে পরিবেশ অ-সচেতনতার। উত্তরাখণ্ড ইহার ভয়ঙ্কর পরিণতি প্রত্যক্ষ করিয়াছে। পরবর্তী নাম এই রাজ্যের না হওয়াই মঙ্গল।