চণ্ডীদাসের খুড়া শৈশবে ‘গুংগা’ ডাকিয়া চমক লাগাইয়াছিলেন। নরেন্দ্র মোদী সরকার ডাক ছাড়িল, পয়লা অগস্ট ‘মুসলিম নারী অধিকার দিবস’। শুনিয়া দেশবাসীর আক্কেল গুড়ুম। ইহা কাহার স্বীকৃতি, কিসের সম্মান? কেন হঠাৎ আলাদা করিয়া মুসলিম নারীর অধিকারের সুরক্ষা চাহে কেন্দ্র? নিঃশর্ত নাগরিকত্বের অধিকার চাহিয়াছিলেন শাহিন বাগের দাদি-সহ লক্ষ লক্ষ মুসলিম মহিলা, তাহা মানিয়া সিএএ-এনআরসি কি তবে বাতিল হইল? অথবা যোগী আদিত্যনাথের সরকার কি শেষে বুঝিয়াছে যে, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের প্রস্তাবিত আইন সম্পর্কে মতামত জানাইবার অধিকার মুসলিম মহিলাদেরও আছে? অথবা এই দিনটিতে কি কাশ্মীরের মহিলাদের তথ্য জানিবার অধিকারকে সম্মান দেখাইয়া, তাঁহাদের নিখোঁজ স্বামী-সন্তানের অনুসন্ধান করিবে সরকার? কলেজ ক্যাম্পাসে মুসলিম ছাত্রীদের আন্দোলনের অধিকার, মুসলিম তরুণীর ভিন্ধর্মের পুরুষকে বিবাহের অধিকার, মুসলিম গৃহবধূর আপন পছন্দের খাদ্য পরিবেশনের অধিকার, কর্মরত মুসলিম মহিলার যে কোনও পাড়ায় বাড়ি ভাড়া পাইবার অধিকার— এই সকল আলোচনার জন্যই কি ওই দিনটি বরাদ্দ হইল? এমন সৌভাগ্য সহসা বিশ্বাস হইতে চাহে না। গত সাত বৎসরে ভারতে মুসলিমদের উপর ক্রমান্বয়ে আঘাত-অসম্মান আসিয়াছে, তাহাদের স্বাধিকার লঙ্ঘিত এবং সুরক্ষা ব্যাহত হইয়াছে। নীরবে দেখিয়াছে শাসক দল বিজেপি, এবং তাহার নেতা-মন্ত্রীরা। আজ হঠাৎ মুসলিম মেয়েদের প্রতি এমন সহানুভূতির বর্ষণ কেন?
না কি, ইহা আসলে তিন তালাক নিবারণী আইনের বর্ষপূর্তি উদ্যাপন? অর্থাৎ সেই খুড়ার কল, যাহা নির্বিকল্প আধিপত্যের চপ-কাটলেট সম্মুখে রাখিয়া ক্রমাগত মানুষকে ছুটাইয়া চলে? লোভের আতিশয্যে মানুষ ভুলিয়া যায়, কোন পথে, কোথায় যাইতেছে দেশ। নচেৎ চোখে পড়িত, তিন তালাক-সংক্রান্ত আইনটিতে মুসলিম মহিলার ‘অধিকার’ অংশত রক্ষিত হইলেও, স্বামীকে জেলে পাঠানো ছাড়া আর কোনও অর্জন তাঁহাদের জন্য নাই। বিবাদের নিষ্পত্তি, বিবাহ-বিচ্ছিন্না মহিলার পারিবারিক সম্পত্তির অধিকার, সন্তানের উপর অধিকার, কিছুই আইন নিশ্চিত করে নাই। আপত্তি উঠিয়াছে যে, এই আইনের প্রণেতারা মুসলিম মহিলার স্বাতন্ত্র্যের স্বীকৃতির অপেক্ষা মুসলিম পুরুষকে ‘অপরাধী’ প্রতিপন্ন করিতে অধিক আগ্রহী। বিজেপি বরাবর মুসলিম পারিবারিক আইন বাতিল করিবার, এবং সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকলের উপর অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রয়োগ করিবার দাবি তুলিয়াছে। এক দিকে সংখ্যালঘুর বিশেষ অধিকারের বিরোধিতা, অন্য দিকে সংখ্যালঘু নারীর জন্য বিশেষ সুরক্ষা?
কোনও বিশেষ উদ্দেশ্যে একটি দিবস নির্দিষ্ট করিবার ধারাটি নূতন নহে। সমাজ এবং রাষ্ট্রের কোনও বিশেষ কর্তব্য মনে করাইতে একটি দিবস নির্ধারণে অসঙ্গত কিছু নাই। নারী অধিকার স্মরণ করাইতে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ পালিত হয় ৮ মার্চ, তৎসহ আমেরিকায় ৩ অগস্ট দিনটি ‘কৃষ্ণাঙ্গ নারীর সমান পারিশ্রমিক দিবস’ হিসাবে উদ্যাপিত হয়। কিন্তু এমন এক একটি দিবসের পশ্চাতে সাধারণত সমাজ-আন্দোলনের দীর্ঘ ইতিহাস থাকে। সরকারের নিজস্ব ধারণা জাতির উপর চাপাইতে ‘দিবস’ ঘোষণা যেন হেঁটমুণ্ড ঊর্ধ্বপদে চলিবার ন্যায়।