জনজাগরণ বুঝি এই ভাবেই ঘটে। দীর্ঘ দিন ধরে ক্ষমতার দাপটে অন্যায়, অবিচার, লাঞ্ছনা, নিপীড়ন সহ্য করতে করতে এক দিন ছাইচাপা আগুন জ্বলে ওঠে। তার স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে দিক হতে ওই দিগন্তরে। দম-বন্ধ-করা ক্ষোভ আর প্রতিবাদের যে সমিধ সঞ্চিত হচ্ছিল সমাজের পরতে পরতে, তা মুহূর্তে সেই স্ফুলিঙ্গের স্পর্শে বহ্নিমান হয়, ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলার আহ্বান ধ্বনিত হয় অমৃতের পুত্রকন্যাদের উদ্দেশে। ২০২৪ সালের ১৪-১৫ অগস্টের সন্ধিকালে রাত্রি দখল করার আহ্বান জানিয়েছেন যাঁরা, তাঁরা এ-রাজ্যের কন্যা। মহানগরের সীমানা অতিক্রম করে দ্রুত, অতি দ্রুত রাজ্যের সমস্ত অঞ্চলে অগণন হৃদয়ের দখল নিয়েছে সংক্ষিপ্ত এবং সুতীব্র ধ্বনি: ওঠো, জাগো, সমবেত হও। শেষ অবধি ঠিক কত জায়গায় কত জন নারী জড়ো হবেন, তার পরিসংখ্যান ক্রমশ প্রকাশ্য। কিন্তু সেই সংখ্যার থেকে অনেক অনেক বেশি মূল্যবান গত কয়েক দিনের এই অভূতপূর্ব ইতিহাস। স্বাধীনতা দিবসের নতুন অর্থ নির্মাণ করার ইতিহাস।
যে ভয়াবহ, মর্মান্তিক এবং পৈশাচিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই রাত্রি দখলের মহা-আয়োজন, তার পরতে পরতে বিভীষিকার সহস্র উপকরণ মজুত আছে, যার এক বিরাট অংশই দৃশ্যত এখনও চোখের আড়ালে, ক্ষমতাবানদের প্রচণ্ড তৎপরতায় হয়তো শেষ অবধি চোখের আড়ালেই থেকে যাবে। কিন্তু সেই পিশাচলীলা এবং তার পরবর্তী ঘটনাক্রম থেকে একটি দগদগে সত্য আবার, আরও এক বার, সম্পূর্ণ নিরাবরণ হয়েছে। এই সমাজে নারীর প্রতিনিয়ত অসম্মানের সত্য। সেই অসম্মানের নানা রূপ, নানা মাত্রা। কিন্তু তার মূলে আছে সমাজমানসের মজ্জায় মজ্জায় নিহিত একটি ধারণা: মেয়েরা পুরুষের সমান স্বাধীনতা দাবি করতে পারেন না। তাঁদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রিত থাকবে সামাজিক অনুশাসনের নির্দেশিকা অনুসারে, তাঁদের জীবনবৃত্ত তাঁদের নিজস্ব ইচ্ছা ও সামর্থ্য অনুযায়ী চলবে না, চলবে সমাজের পছন্দ মাফিক। এই কারণেই বার বার একটি মেয়ের উপর পৈশাচিক আক্রমণের পরে প্রায় অবধারিত ভাবে সমাজ রাজনীতির ক্ষমতাধরদের কণ্ঠে প্রশ্ন শোনা যায়: ওই সময়ে সে ওখানে কী করছিল, কেন গিয়েছিল, কী দরকার ছিল তার গণ্ডি ভাঙার? যে আক্রান্ত, তাকেই অপরাধী সাব্যস্ত করার অন্যায় মেয়েদের ক্ষেত্রে সামাজিক অনুমোদন পেয়ে যায় এই একটি প্রশ্নের মাধ্যমেই, এমনকি মহিলারা ক্ষমতাসীন হলে তাঁরাও সরাসরি বা পরোক্ষ ভাবে এই প্রশ্ন ছুড়ে দেন অত্যাচারিত, ধর্ষিত, এমনকি নিহত মেয়েটির প্রতি, প্রশ্ন তোলেন সেই মেয়ের ‘স্বভাব’ নিয়ে! এই সমাজে নারীর স্ব-ভাব তার স্ব-অধীন হতে পারে না, তাকে সামাজিক অনুশাসনের অধীন হতে হয়।
এই অনুশাসনের মুখের উপর একটি বিরাশি সিক্কার প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে মধ্যরাত্রের আহ্বান: মেয়েরা রাত দখল করো। এই আয়োজন অবশ্যই প্রতীকী। একটি রাত্রিতে মেয়েরা নাগরিক মানচিত্রের জনপরিসরের দখল নিলেই রাজ্যে নারীর সামাজিক অবস্থান পাল্টাবে না, তাঁদের নিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে না। আয়োজনের উদ্যোক্তাদের নিশ্চয়ই সে-কথা অজানা নয়। কিন্তু প্রতীক কখনও কখনও নতুন ইতিহাসের অনুঘটক হয়ে উঠতে পারে। পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যটি বহু দিন যাবৎ গড্ডলিকায় শামিল। স্থবির শান্তিকল্যাণই এ রাজ্যের স্বধর্মে পরিণত হয়েছে। এমনকি প্রতিবাদ বিক্ষোভ আন্দোলনও গতানুগতিকতার বলয় থেকে নিষ্ক্রান্ত হতে পারে না। সেই কারণেই জনপরিসরে মেয়েদের এই সসম্মান স্বাধিকারের দাবি পশ্চিমবঙ্গকে এক বিরল মর্যাদা এনে দিয়েছে। আত্মমর্যাদা পুনরুদ্ধারের সুযোগ এসেছে সমস্ত সুচেতন নাগরিকের সামনে। পশ্চিমবঙ্গের সমাজ যদি এই উদ্যোগকে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে পারে, এক দিনের জন্য নয়, প্রতি দিনের জন্য নারীর স্বাধিকারকে স্বীকার করতে পারে, তবে ২০২৪ সালের ১৫ অগস্ট ক্যালেন্ডারের সীমা ছাড়িয়ে ঐতিহাসিক হয়ে উঠবে।