কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়ঙ্কা গান্ধী। ফাইল চিত্র।
কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়ঙ্কা গান্ধী সম্প্রতি হিমাচল প্রদেশের নির্বাচনী প্রচারে রাজ্যবাসীদের পরামর্শ দিয়েছেন, মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে না ভুলে তাঁরা যেন নিজেদের ভবিষ্যৎ ভেবে ভোট দেন। রাজনীতিকদের মিথ্যা প্রতিশ্রুতির ইতিহাস অতি প্রাচীন, তা নিয়ে গত শতাব্দীর সাংবাদিক ও সমাজ-পর্যবেক্ষক দাদাঠাকুরের তৈরি অসামান্য কৌতুকগীতিও বহু-উদ্ধৃত। তবে কিনা, প্রিয়ঙ্কা গান্ধী গীতিকার নন, সাংবাদিকও নন, তিনি দলনেত্রী। যে দলের নেত্রী, তার রাজনৈতিক হাল খারাপ বললে কম বলা হয়, সেই দলের নেত্রী হিসাবে তাঁর নিজের হালও তথৈবচ। নিন্দকরা হয়তো বলবেন— আগে নিজের এবং নিজেদের ভবিষ্যৎ ভাবুন, তার পরে নাগরিকদের ভবিষ্যৎ ভাববার উপদেশ দেবেন। বলতেই পারেন, কিন্তু তাঁর বক্তব্যটির মূল্য তাতে কমে না। যে পরিপ্রেক্ষিতে তিনি কথাটি বলেছেন, তার গুরুত্বও অস্বীকার করবার কোনও উপায় নেই। রাজনীতির প্রচারে, বিশেষত নির্বাচনী মরসুমে সব দলই অতিকথন করে থাকে, তবে বর্তমান কেন্দ্রীয় শাসকদের যথেচ্ছ প্রতিশ্রুতির মাত্রা যেখানে পৌঁছেছে, দাদাঠাকুর তা স্বপ্নে ভাবতে পারতেন না, স্বাধীন ভারতের রাজনীতির ইতিহাসেও তার তুলনা মিলবে না। বস্তুত, শাসক দলের অন্যতম প্রধান নেতা এবং দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অনেক দিন আগেই পরোক্ষে সেই অভূতপূর্বতার কথা নিজের মুখেই জানিয়ে দিয়ে ‘জুমলা’ শব্দটিকে জনপরিসরে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
এই পরিপ্রেক্ষিতেই প্রিয়ঙ্কা গান্ধীর ‘ভবিষ্যৎ ভাবনা’ বিশেষ তাৎপর্য দাবি করে। বাস্তবিকই, ভবিষ্যৎ যদি কেবল অবাস্তব প্রতিশ্রুতির বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, তা হলে নাগরিকদের, বিশেষ করে তরুণ নাগরিকদের সামনে কোন বিপুল অন্ধকার অপেক্ষা করে আছে, সেই প্রশ্ন ভীতিপ্রদ হয়ে ওঠে বইকি। লক্ষণীয়, ভারতীয় রাজনীতি থেকে প্রকৃত উন্নয়নের চিন্তা এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে যথার্থ বড় ভাবনা কার্যত অন্তর্হিত হয়েছে। ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যাবে, কেবল জওহরলাল নেহরুর আমলে নয়, তার পরবর্তী কালের বিভিন্ন জমানাতেও তেমন চিন্তাভাবনার পরিচয় মিলত। সমস্ত অপূর্ণতা এবং অতিকথনের আবরণ সরিয়ে দেওয়ার পরেও সদর্থক ভবিষ্যৎ-ভাবনার যে ছবি পাওয়া যেত, আজ তা রূপকথা মনে হতে পারে। ভবিষ্যৎকে জুমলার গহ্বরে নিক্ষেপ করে রাজনীতির প্রচার এখন প্রায় সম্পূর্ণত অতীত ও বর্তমানের গরল মন্থনে পর্যবসিত হয়েছে। শাসকদের প্রবল তৎপরতায় এক দিকে চলেছে অতীতের ‘পুনর্নির্মাণ’, অন্য দিকে বর্তমানকে নানা দিক থেকে বিভেদ ও বিদ্বেষের রণক্ষেত্রে পরিণত করা হচ্ছে। এই দুই প্রকল্প বিচ্ছিন্ন নয়, গভীর ভাবে সম্পৃক্ত— অতীতকে এমন ভাবে পুনর্নির্মাণ করা হচ্ছে, যা বর্তমানের বিদ্বেষকে ক্রমাগত উত্তেজিত করে।
এই প্রক্রিয়াটি যে ভবিষ্যতের বিপন্নতা বহুগুণ বাড়িয়ে তুলছে, সে-কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। বর্তমান পরিস্থিতিতে এই বাস্তব দ্বিগুণ দুর্ভাগ্যজনক, কারণ জনবিন্যাসের গতিপ্রকৃতির কারণে ভারত এখন সম্ভাবনাময় বড় দেশগুলির মধ্যে দুনিয়ায় কার্যত ‘তরুণতম’। এই তারুণ্যের সুযোগ এখনও বেশ কিছু কাল তার আয়ত্ত থাকবে। কিন্তু সেই সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য সমস্ত নেতিবাচক রাজনীতি দূরে সরিয়ে রেখে শিক্ষায় স্বাস্থ্যে পুষ্টিতে পরিকাঠামোয় উন্নতিসাধনের জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করা জরুরি। সেই জরুরি উদ্যোগ সাধিত হলে তবেই ভবিষ্যৎ বর্তমানের থেকে উজ্জ্বলতর হতে পারে। অথচ দেশের রাজনীতিকরা, বিশেষত কেন্দ্রের ও অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যের শাসক দলের নেতারা তার বিপরীতে চলতে বদ্ধপরিকর। প্রিয়ঙ্কা গান্ধী এবং তাঁর দল যদি তাঁর কথাকে মর্যাদা দিয়ে প্রকৃত ব্যতিক্রমী রাজনীতি গড়ে তুলতে পারে, তা কেবল দলের পক্ষে নয়, দেশের পক্ষেও কল্যাণকর হবে। কথার চেয়ে কাজ অবশ্য অনেক বেশি কঠিন।