প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। —ফাইল চিত্র।
কোনও ঘটনাকে স্রেফ পরিবেশনের নাটকীয়তায় সকলকে চমকে দেওয়ার ক্ষমতাটি ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর মজ্জাগত। সদ্যসমাপ্ত জি২০ সম্মেলন তার উদাহরণ। এই আন্তর্জাতিক মঞ্চটিকে ব্যবহার করে নিজের বৈশ্বিক ‘ইমেজ’ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনায় তিনি অনেকটাই সফল। একই ভাবে এ বছর নিজের জন্মদিনের দিনেই তিনি যখন প্রথাগত শিল্পী ও কারিগরদের জন্য বিশেষ ‘পিএম বিশ্বকর্মা যোজনা’ চালু করার কথা ঘোষণা করলেন, সন্দেহের অবকাশ ছিল না যে আসন্ন কিছু বিধানসভা ও লোকসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়েই তা করা হল। কেন্দ্রীয় সরকারের দাবি, প্রকল্পটির মূল লক্ষ্য— দেশের আঠারোটি ক্ষেত্রের কারিগরদের দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সহজ কিস্তিতে ঋণের সুবিধা প্রদান। কিন্তু বিরোধীদের কটাক্ষ, সরকারের লক্ষ্য প্রকৃতপক্ষে আসন্ন ভোটের আবহে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির (ওবিসি) সমর্থন নিশ্চিত করা।
বিরোধীরাও অবশ্য জানেন, পদক্ষেপটি সাধু। তবে কিনা, এ সরকারেরই পূর্বতন দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্পের ফলাফলের চিত্রটি যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক নয়। দেশের বিপুল সংখ্যক যুবককে শিল্পক্ষেত্রের উপযোগী দক্ষতা প্রদান করে কর্মসংস্থান বাড়ানোর উদ্দেশ্যে ২০১৫ সালের জুলাই মাসে সাড়ম্বরে স্কিল ইন্ডিয়া মিশন-এর অন্তর্গত প্রধানমন্ত্রী কৌশল বিকাশ যোজনা-র (পিএমকেভিওয়াই) সূচনা করেন নরেন্দ্র মোদী। এ-যাবৎ প্রকল্পটির তিনটি সংস্করণ সম্পাদিত হয়েছে সরকারের তরফে। তথ্য অনুযায়ী, পিএমকেভিওয়াই প্রকল্পের প্রথম সংস্করণে মোট যত জন প্রশিক্ষণ লাভ করেন, তার মাত্র আঠারো শতাংশ শেষ পর্যন্ত চাকরির বাজারে যোগ দিতে সক্ষম হন। তথ্য অনুযায়ী, দ্বিতীয় সংস্করণে তা কিছুটা বাড়লেও, তা পুনরায় নিম্নমুখী হয়। ফলে গত আট বছরে প্রকল্পের লক্ষ্যমাত্রা কার্যত অপূর্ণই থেকে গিয়েছে। এর কারণ বিবিধ। প্রথমত, প্রশিক্ষণ প্রদানের উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাবের পাশাপাশি ভাল প্রশিক্ষকের অভাব। দ্বিতীয়ত, প্রশিক্ষণের সঙ্গে শিল্পক্ষেত্রের চাহিদার অসামঞ্জস্য। অনেক ক্ষেত্রে উন্নত দক্ষতার প্রয়োজন থাকলেও দ্বিপাক্ষিক সংযোগের অভাবে প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়াগুলি পুরনো স্তরেই আটকে থাকে। তৃতীয়ত, প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলির মান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে নজরদারি হয় না। এ ছাড়াও, প্রকল্পের অপর্যাপ্ত প্রচার, যুবসমাজের অনেকেরই এই ধরনের প্রশিক্ষণের প্রতি অনীহা, বেসরকারি বিনিয়োগের অভাব, প্রশিক্ষণে নিযুক্ত এবং তহবিল সংক্রান্ত দুর্নীতি এই প্রকল্পের সাফল্যের ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। পরিহাস এটাই যে, এ দেশে যেখানে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেও যুবসমাজ বেকার থাকে, সেখানে জলের পাম্প সারানোর দক্ষ কারিগর মেলে না। ফলে, কারিগরদের প্রকল্পটিরও যে একই পরিণতি হবে না, এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
প্রশ্ন আরও। দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্পকে হিন্দু দেবতার নামে নামকরণ করার একটিই উদ্দেশ্য— ভোট ব্যাঙ্কের সন্তোষবিধান। কিন্তু লক্ষ্য যেখানে শিল্পী-কারিগরদের দক্ষতা বৃদ্ধি, সেখানে এই সহজিয়া ভোটসাধনা বিস্তর সন্দেহ উদ্রেক করে। অর্থাৎ যে দেশে মানবসম্পদের উন্নয়ন একটি জটিল ও বহুমাত্রিক বিষয়, যেখানে সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থের বীক্ষণযন্ত্র দিয়ে তাকে দেখলে— উন্নয়ন আদৌ তার অন্বিষ্ট মাত্রায় পৌঁছবে কি না, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।