রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে উপলক্ষ করে দলীয় রাজনীতির টানাপড়েন এ দেশে নতুন কিছু নয়। তার সঙ্গে নীতি বা আদর্শগত অবস্থানের প্রশ্ন কখনও-কখনও জড়িয়ে থাকে, যদিও সেই প্রশ্নকে কোনও দিনই দল ভারী করার পাটোয়ারি বুদ্ধি থেকে আলাদা করা যায়নি। এমনকি ১৯৬৯ সালে বরাহগিরি বেঙ্কট গিরি বনাম নীলম সঞ্জীব রেড্ডির ঐতিহাসিক দ্বৈরথও শেষ বিচারে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর রাজনৈতিক কূটবুদ্ধির প্রমাণ হিসাবেই স্মরণীয়— তাঁর ‘প্রগতিশীল’ আর্থিক নীতি এবং সেই নীতির কল্যাণে বামপন্থীদের সমর্থন নিয়ে ভি ভি গিরির বিজয় দেখিয়ে দিয়েছিল, রাজনীতিকে কেন সম্ভবের শিল্প বলা হয়ে থাকে। সেই মাত্রার রুদ্ধশ্বাস নাটক আর দেখা যায়নি বটে, কিন্তু পরবর্তী অর্ধ শতাব্দীতে বারংবার রাষ্ট্রপতি পদের প্রার্থী নির্ধারণের সময় শাসক এবং বিরোধী, উভয় পক্ষই নানা ধরনের অঙ্ক কষতে ব্যস্ত হয়েছে। সেই হিসাবনিকাশের লক্ষ্য: নির্ধারিত প্রার্থীর সপক্ষে আপন শিবিরের ভোট সংহত করা, প্রতিপক্ষের ভোটে ভাগ বসানো এবং মধ্যবর্তীদের ভোট টেনে আনা। রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত মর্যাদা তথা গুণগত উৎকর্ষের প্রশ্ন উত্তরোত্তর গৌণ হয়ে পড়েছে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পর্যবসিত হয়েছে রাজনৈতিক শিবির গঠনের উপলক্ষে।
এ-বারের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিরোধীদের হাতে অস্ত্র বিশেষ নেই। যে কোনও উপায়ে এক জন প্রার্থীকে সমবেত ভাবে দাঁড় করানোটাই ছিল তাঁদের সংহতি জানানোর একমাত্র উপায়। সেই বাস্তবকে মেনে নিয়েই তাঁরা একের পর এক সম্ভাব্য প্রার্থীর দ্বারে দ্বারে ঘুরে শেষ পর্যন্ত যশবন্ত সিন্হাকে মনোনীত করেছেন। ভূতপূর্ব বিজেপি এবং (সম্প্রতি আগত ও সদ্য বিদায়ী) তৃণমূল কংগ্রেস রাজনীতিককে নিয়ে বামপন্থী মহলে অনেকেই ধর্মসঙ্কটে কাতর হয়েছেন বটে, কিন্তু সেটা তাঁদের পরিণত বাস্তববুদ্ধির পরিচয় দেয় না। এই একটি ক্ষেত্রে বরং সিপিআইএম-এর কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বাস্তবকে স্বীকার করে নিয়ে কর্তব্য সম্পাদনে দ্বিধা করেননি। দলের এই নিরুপায় অবস্থার একটি কারণ আইনসভায় তাঁদের হীনবল দশা। কিন্তু আর একটি সত্যও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়— যশবন্ত সিন্হার পূর্বাশ্রমে সঙ্ঘ পরিবারের ভূমিকাটি নিয়ে কোনও বিরোধী দলেরই বিশেষ মাথাব্যথা নেই, এমনকি কংগ্রেসেরও নয়। এই অবস্থায় বঙ্গীয় বামপন্থীদের যে সব বীরপুরুষ ও বীরাঙ্গনারা দলীয় সিদ্ধান্ত নিয়ে আপন পবিত্র ক্রোধ জানিয়ে চলেছেন, বিচক্ষণ নাগরিক তাঁদের প্রতি করুণাই বোধ করবেন।
বস্তুত, যেখানে নিজস্ব কোনও ক্ষমতা নেই, সেখানে অন্তত বিরোধী সংহতির স্বার্থে আপস করে নেওয়াই যে রাজনীতির স্বাভাবিক নিয়ম, বামপন্থীদের সিদ্ধান্তে তারই স্বীকৃতি। এই দৃষ্টান্ত থেকে অন্য বিরোধী দলগুলিরও শেখার আছে। তাদের অনেকের আচরণেই বিভিন্ন উপলক্ষে এই বাস্তবমুখী বিবেচনাবোধের পরিচয় মেলেনি। গোটা দেশে, বিশেষত উত্তর ভারতে নিতান্ত প্রান্তিক শক্তিতে পরিণত হওয়ার পরেও কংগ্রেস কিছুতেই নিজের অতীত গরিমার মায়া ছাড়তে পারে না, আজও সে নিজেকে বিরোধী রাজনীতির স্বাভাবিক কেন্দ্রবিন্দু বলেই বার বার ভাবতে চায়। আবার, তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গের একটি দল হয়ে সর্বভারতীয় বিরোধী রাজনীতিতে অনেক বেশি গুরুত্বের দাবি করে এবং অন্যেরা সেই দাবি না মানলেই তৎক্ষণাৎ গোসাঘরে ঢোকে। এই ধরনের আচরণে ক্ষতি হয় সংহত ও সংগঠিত বিরোধী রাজনীতির, ভারতীয় গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে যে সংহতি এবং সংগঠন এখন কেবল প্রয়োজনীয় নয়, অত্যন্ত জরুরি। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রার্থী নির্ধারণে যেটুকু সমন্বয় বিরোধীদের মধ্যে দেখা গেল, তা এই পরিপ্রেক্ষিতেই মূল্যবান। বলা বাহুল্য, বিরোধী ঐক্যের ভবিষ্যৎ এখনও বিশ বাঁও জলে। কিন্তু প্রথম পদক্ষেপ ছাড়া কোনও অগ্রগতিই সম্ভব নয়।