রাষ্ট্রপতি পদে এনডিএ-র প্রার্থী হিসাবে দ্রৌপদী মুর্মুকে মনোনীত করার সিদ্ধান্তটিকে ‘ঐতিহাসিক’ না বলার কোনও কারণ নেই। অনস্বীকার্য যে, এই সিদ্ধান্তের পিছনে বিজেপির রাজনৈতিক স্বার্থের সমীকরণটি জাজ্বল্যমান। তাঁকে প্রার্থী করলে একাধিক আঞ্চলিক দল এই নির্বাচনে বিজেপিকে সমর্থন করতে বাধ্য হবে— বিজেডি ইতিমধ্যেই সমর্থন জানিয়েছে, এমনকি জেএমএম-ও। এ হিসাব আগে থেকেই কষা ছিল। তা ছাড়া, এ বছরই গুজরাতে বিধানসভা নির্বাচন; ২০২৩-এ মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও ছত্তীসগঢ়ে নির্বাচন। এই চার রাজ্য মিলিয়ে মোট ১২৮টি আসন তফসিলি জনজাতির জন্য সংরক্ষিত। গত নির্বাচনে বিজেপি তার মধ্যে পেয়েছিল মাত্র ৩৫টি আসন। সুতরাং, এই নির্বাচনগুলির আগেই জনজাতিভুক্ত দ্রৌপদী মুর্মু বিজেপি-মনোনীত প্রার্থী হিসাবে দেশের রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হলে বিজেপির বিলক্ষণ লাভ। শুধু এই রাজ্যগুলিতেই নয়, যেখানেই জনজাতিভুক্ত জনগোষ্ঠী রাজনৈতিক ভাবে তাৎপর্যপূর্ণ— ঘটনাক্রমে, সেই অঞ্চলগুলিতে বিজেপির রাজনৈতিক মুষ্টি ইদানীং বেশ শিথিল— সেখানেই রাজনৈতিক লাভের সম্ভাবনা যথেষ্ট। সুতরাং, রামনাথ কোবিন্দের মতোই, পরবর্তী রাষ্ট্রপতি প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রেও বিজেপি ছকের বাইরে পা ফেলার কৌশল কেন করছে, বুঝতে অসুবিধা হয় না। তবে, সংসদীয় গণতন্ত্রে সব দলই ভোটের জল মেপে পা ফেলে। সে কথা মাথায় রেখে বলাই যায় যে, জল মাপতে মাপতেও যে জনজাতিভুক্ত এক মহিলা— অর্থাৎ, ভারতে সামাজিক অবদমনের দুই বৃহৎ পাষাণখণ্ডে চাপা পড়ে থাকা মানুষের এক প্রতিনিধি— দেশের সাংবিধানিক শীর্ষপদে অধিষ্ঠিত হওয়ার মনোনয়ন পাচ্ছেন, সামাজিক ন্যায়ের পরিপ্রেক্ষিতে এই ঘটনাটি অতি তাৎপর্যপূর্ণ। দ্রৌপদী মুর্মুর মনোনয়নে বাস্তবিক একটি সুকঠিন কাচের ছাদ চুরমার হল। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯ শতাংশ জনজাতিভুক্ত, তাঁদের এক জনকে দেশের সাংবিধানিক শীর্ষপদে দেখতে স্বাধীনতার পরে ৭৫ বছর অপেক্ষা করতে হল। আশা থাকল, অদূর ভবিষ্যতে বর্তমান শাসকরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি উদার সমদর্শিতা দেখাতেও পিছপা হবেন না!
এ দিকে, প্রশ্ন ও সংশয় ইতিমধ্যে অসংখ্য। বিজেপি ও সঙ্ঘের রাজনৈতিক কৌশলের পাশাপাশি তাদের মতাদর্শ-মানচিত্রে জনজাতিভুক্ত এবং দলিত জনগোষ্ঠীর স্থানটি ঠিক কোথায়? সঙ্ঘের হিন্দুত্ববাদ সমগ্র হিন্দু সমাজকে একীভূত করতে চায়, এক ছাতার তলায় আনতে চায়। কিন্তু সেই ব্যবস্থায় নিম্নবর্ণ এবং জনজাতির ভূমিকাটি ঠিক কেমন? সঙ্ঘের অভ্যন্তরেও এ নিয়ে স্ববিরোধ আছে— গোলওয়ালকর যেখানে বর্ণাশ্রমের দৃঢ় সমর্থক, সেখানে কয়েক দশকে রাজনীতির তাগিদেই সঙ্ঘ জাতিভেদ প্রথাকে অতিক্রম করতে চেয়েছে। তবে কিনা, একটি অলঙ্ঘ্য দ্বন্দ্বের সামনে দুই ধারাকেই এক জায়গায় দাঁড়াতে হয়, দলিত ও জনজাতিভুক্ত মানুষদের বৃহৎ হিন্দুত্বের ছত্রছায়ায় আনতে গেলে তাঁদের প্রতি ঐতিহাসিক অন্যায়গুলিকে অস্বীকার করতে হয়। ‘সব হিন্দুই সমান’, এই আপাত-সমদর্শিতার আড়ালে ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রবল আধিপত্যকে ঢাকতে হয়। কিন্তু তাকে ঢাকা হবে কী করে, যখন সেই আধিপত্য প্রতি দিন বলিষ্ঠ ভাবে উদ্যাপিত হচ্ছে বিজেপি-শাসিত ভারতে? বনাঞ্চলে বাসস্থানের অধিকার থেকে খাদ্যাভ্যাস, সংস্কৃতি, বিবিধ জীবনযাপনের কোনও অধিকারই তো বর্তমান শাসক ও তার সমর্থকগণ স্বীকার করতে রাজি নয়! এমনকি সংরক্ষণের মাধ্যমে সমতা প্রতিষ্ঠার যে প্রয়াস সদ্যস্বাধীন দেশের সরকার করেছিল, তারও বিরোধিতা করে সঙ্ঘ। তবে কি রামনাথ কোবিন্দ ও দ্রৌপদী মুর্মুরা এ দেশে নেহাত রাজনৈতিক ঘুঁটি হয়েই থেকে যাবেন? এটাই তা হলে বিজেপির রাজনীতি? দেশের সাংবিধানিক প্রধান হওয়ার যে গুরুত্ব, সুযোগের সমতার যে স্বীকৃতি, সে সবই শেষ পর্যন্ত লোকদেখানো?
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।