তর্কের খাতিরে ধরিয়া লওয়া গেল, পেগাসাস ঘটিত সমস্ত অপকীর্তির অভিযোগ অসত্য। কিন্তু যখন অভিযোগের তাৎপর্য সুগভীর এবং তাহার পরিধি সুদূরপ্রসারিত, তখন রাষ্ট্রযন্ত্রের চালকদের কর্তব্য ছিল প্রবল উদ্যমে সত্য উদ্ঘাটনে সর্বশক্তি প্রয়োগ করা। অথচ কেন্দ্রীয় সরকার ঠিক তাহার বিপরীত পথে হাঁটিতেছে। এই বিতর্কে যথার্থ ‘সরকারি বয়ান’ বলিতে আপাতত নবনিযুক্ত তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রীর সংসদে প্রদত্ত বিবৃতিটিই সর্বাগ্রে বিচার্য। অশ্বিনী বৈষ্ণব জানাইয়াছেন, দেশের আইন এবং তদারকি ব্যবস্থা এমনই সবল যে, বেআইনি নজরদারির কোনও সম্ভাবনাই নাই। স্পষ্টতই, ইহাতে কোনও প্রশ্নের সদুত্তর মিলে নাই, বরং দুইটি গুরুতর প্রশ্ন উঠিয়াছে। এক, ‘আইনি’ নজরদারি কি হইয়াছে? হইলে কোন উদ্দেশ্যে কী ভাবে কাহার উপর হইয়াছে? দুই, নজরদারির ‘সম্ভাবনা নাই’ এবং নজরদারি ‘হয় নাই’— এই দুইয়ের মধ্যে যে বিপুল দূরত্ব, তাহার দায়িত্ব কে লইবেন? নবাগত মন্ত্রিবর, যাঁহার নিজের নামই নজরদারি অন্যতম নিশানা বলিয়া প্রচারিত? শ্রীবৈষ্ণবের ঝুলিতে যথার্থ সদুত্তরের খুদকুঁড়াও নাই বলিয়াই কি পবিত্র ক্রোধের সুরে ‘সবই সরকার ও দেশের গণতন্ত্রকে কালিমালিপ্ত করিবার চেষ্টা’ নামক সেই পুরানো কীর্তনই গাহিতেছেন তিনি?
সঙ্কীর্তন বলা-ই শ্রেয়। বিরোধী এবং প্রতিবাদী নাগরিকদের উপর আড়ি পাতিবার অত্যন্ত উদ্বেগজনক অভিযোগের জবাবে দিল্লীশ্বররা শুরু হইতেই যে ধুয়াটি ধরিয়াছেন তাহার নাম: দেশপ্রেম। সত্য দেশপ্রেম নহে, দেশপ্রেমের ছল। রাষ্ট্রচালকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উঠিলেই তাঁহারা এই ছলটিকে ব্যবহার করিয়া বলেন: দেশের দুর্নাম করা হইতেছে। প্রতিবাদ বা অভিযোগ আন্তর্জাতিক স্তরে সংগঠিত হইলে তাঁহাদের এই দেশাভিমান জাহির করিবার বিশেষ সুবিধা হয়। এই ক্ষেত্রেও হইয়াছে। ভারত সরকার পেগাসাস ব্যবহার করিতেছে কি না তাহার স্পষ্ট উত্তর না দিলেও সদ্য-প্রাক্তন তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী যখন প্রশ্ন তোলেন— চল্লিশটির অধিক দেশ পেগাসাস ব্যবহার করিতেছে, কেবল ভারতের নামে অভিযোগ কেন, তখন দেশপ্রেম তথা জাতীয়তাবাদের তাসটি খেলিবার ব্যগ্রতাই প্রকট হয়। সেই ব্যগ্রতারই উৎকট প্রতিফলন ঘটে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়ায়, তিনি ‘ক্রনোলজি’ সমঝাইবার পুরানো পাঠ দিতে বসিয়া বলেন, সংসদের অধিবেশন শুরু হইবার পূর্বাহ্ণে ‘বিশৃঙ্খলার স্রষ্টা’রা ‘ব্যাঘাত সৃষ্টি’ করিতে তৎপর হইয়াছে। অর্থাৎ, যাঁহারাই নজরদারির অভিযোগ লইয়া উদ্বেগ জানাইতেছেন এবং তদন্তের দাবি তুলিতেছেন, তাঁহারাই দেশে বিশৃঙ্খলা ও ব্যাঘাত সৃষ্টি করিতেছেন। দেশদ্রোহী বা আর্বান নকশাল গোছের তকমাগুলিও হয়তো অচিরেই বাহির হইবে।
দেশের সম্মান এবং গণতন্ত্রের মর্যাদা লইয়া সত্যই যদি রাষ্ট্রের শাসকরা এত চিন্তিত, তবে একটি সহজ কাজ করিতে আপত্তি কোথায়? সমস্ত বিষয়টি লইয়া অবিলম্বে সংসদে আলোচনা শুরু করিবার আয়োজনই তো গণতান্ত্রিক দেশের পক্ষে এই ধরনের সমস্যা মোকাবিলার শ্রেষ্ঠ উপায়? জনপ্রতিনিধিদের সমক্ষে সরকার নিজের বক্তব্য জানাইবে, বিরোধীরা তাঁহাদের প্রতিযুক্তি পেশ করিবেন, প্রয়োজনে সমগ্র বিষয়টি লইয়া সর্বদলীয় অনুসন্ধানের ব্যবস্থা হইবে, সত্য উন্মোচিত হইবে, বিশ্বজগৎ ভারতীয় গণতন্ত্রের মহিমা দেখিয়া ধন্য ধন্য করিবে... এই অবধি শুনিয়া কি শাসকের চিত্তে প্রবল আন্দোলন উপস্থিত হইতেছে? তাঁহারা কি ভাবিতেছেন: নৈব নৈব চ! প্রকৃত সত্য গোপন করিতে সর্বশক্তি প্রয়োগই কি তাঁহাদের একমাত্র লক্ষ্য? সেই কারণেই হয়তো প্রধানমন্ত্রী— যথারীতি— এত বড় অভিযোগ লইয়া একটি শব্দও খরচ করেন নাই। এই নীরবতা যে কোনও কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন নাগরিকের মনে একটি গভীর সংশয়কে গভীরতর করিবে: পেগাসাস ঘটিত সমস্ত অপকীর্তির অভিযোগই বুঝি সত্য।