সম্প্রতি পূর্বের অরুণাচল প্রদেশ— দুই দিকেই চিনা আগ্রাসন প্রতিহত করতে ভারতের তৎপরতা ও সাফল্য নিয়ে নানা মহল থেকেই প্রশ্ন উঠেছে। প্রতীকী ছবি।
সীমান্তের সংঘাত কোন দিকে কত দূর যাবে, সেই প্রশ্নের উত্তর ভবিষ্যতের গর্ভে। কিন্তু দেশের রাজনীতিতে তার প্রভাব ইতিমধ্যেই ঘনঘোর। চিনের সঙ্গে বিবাদ নিয়ে শাসক ও বিরোধী দলের সওয়াল-জবাব অব্যাহত। কয়েক বছর ধরে পশ্চিমের লাদাখ এবং সম্প্রতি পূর্বের অরুণাচল প্রদেশ— দুই দিকেই চিনা আগ্রাসন প্রতিহত করতে ভারতের তৎপরতা ও সাফল্য নিয়ে নানা মহল থেকেই প্রশ্ন উঠেছে। বিরোধী রাজনৈতিক শিবির স্বভাবতই নীরব থাকেনি। বিশেষত কংগ্রেস চিনের মোকাবিলায় ভারতের সামরিক ও কূটনৈতিক ভূমিকা নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে সমালোচনা করেছে। এই সমালোচনা বিরোধী দলের প্রাথমিক কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। তার উত্তরে কেন্দ্রীয় সরকার নিজেদের বিশদ বক্তব্য পেশ করবে, তথ্য এবং যুক্তি সহকারে সমালোচকদের উত্থাপিত প্রশ্নের জবাব দেবে, তাদের প্রতিযুক্তি খণ্ডন করবে, এমনটাই সঙ্গত ও প্রত্যাশিত। কিন্তু সেই প্রত্যাশা অতীতেও পূর্ণ হয়নি, এখনও অপূর্ণ। চিন সীমান্তের ঘটনাবলি সম্পর্কিত প্রশ্নে সমালোচনার সদুত্তর দেওয়ার বদলে মোদী সরকার বরাবরই নানা ভাবে পাশ কাটিয়ে গিয়েছে, আজও সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে।
বিরোধীরা দুই দেশের সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে সাম্প্রতিক সংঘর্ষ এবং তার পূর্বাপর ঘটনাবলি নিয়ে সংসদে আলোচনার যে দাবি জানাচ্ছে, সরকার তা মানতে নারাজ। প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও বিদেশমন্ত্রী সংসদে বক্তব্য পেশ করেছেন, কিন্তু সেটা জনপ্রতিনিধিদের আলোচনা এবং তর্কবিতর্কের বিকল্প হতে পারে না। বিশেষত, সরকারি ভাষ্য যখন সংশয় নিরসনের বদলে সংশয় আরও বাড়িয়ে তোলে। অতীতে প্রধানমন্ত্রী যখন বলেছিলেন, কেউ বাইরে থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে দেশের ভূখণ্ডে ঢোকেনি, সেই আশ্বাসের সঙ্গে বাস্তব পরিস্থিতির মিল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়েছিল। আজও বিদেশমন্ত্রী যখন বলছেন চিন একতরফা ভারতের সঙ্গে সীমান্তবর্তী নিয়ন্ত্রণরেখায় পরিবর্তন ঘটাতে পারবে না, তখন কংগ্রেসের সাংসদরা সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন তুলেছেন: সীমান্ত এলাকার বাস্তব কি এই আশ্বাসকে সমর্থন করছে? সন্তোষজনক উত্তর মেলেনি। তার বদলে শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীরা পাল্টা অভিযোগ করছেন যে, বিরোধীরা চিন-ভারত সংঘাতের ব্যাপারে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অমর্যাদা করছেন। সেনাবাহিনীর অমর্যাদা অবশ্যই প্রতিবাদযোগ্য। চিনা আগ্রাসনের প্রসঙ্গে কংগ্রেস নেতারা যখন ‘পিটাই’-এর মতো শব্দ ব্যবহার করেন, সেই বাগ্ভঙ্গির সমালোচনাও অযৌক্তিক নয়। কিন্তু সীমান্তের পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশদ জানতে চাইলে, সরকারি নীরবতার সমালোচনা করলে বা সরকারি ভাষ্যের যাথার্থ্য নিয়ে সংশয় প্রকাশ করলে সেনার অমর্যাদা কেন হবে? শাসকরা কি সেনার মর্যাদা বা অপমানের ধুয়ো তুলে নিজেদের দায়দায়িত্ব আড়াল করতে চাইছেন? যুক্তিতথ্যের ঘাটতি ঢাকতে চাইছেন আবেগ দিয়ে?
জাতীয় নিরাপত্তা এবং বিদেশ নীতির সঙ্গে দেশি রাজনীতির স্বার্থ জড়িয়ে গেলে অসার আবেগ প্রাধান্য পায়, তাতে দেশের ক্ষতি। লক্ষণীয়, বিরোধীরাও সেই আবেগ ভাঙানোর তাগিদে চিনের সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য সরকারকে ‘অপরাধী’ সাব্যস্ত করেন! অথচ সীমান্ত বিরোধের মোকাবিলায় বাণিজ্য বা অর্থনীতিকে জড়ানোর কোনও সুযুক্তি থাকতে পারে না, চিনের সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেন ‘বয়কট’ করে সামরিক মোকাবিলা বা কূটনৈতিক বোঝাপড়ার ভার লাঘব করা চলে না। সীমান্ত বিবাদ কোনও সহজ বা সরল ব্যাপার নয়, তার নিরসনের জন্য একটি পরিণত রাষ্ট্রনীতি অত্যন্ত জরুরি। প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সরকার সমস্ত রাজনৈতিক দলকে সঙ্গে নিয়ে সেই নীতি রচনা ও রূপায়ণে উদ্যোগী হলেই নাগরিকরা ভারতীয় রাষ্ট্রের পরিণতবুদ্ধি সম্পর্কে আশ্বস্ত হবেন।