—প্রতীকী চিত্র।
একুশে আসুক না আসুক, আজ ফেব্রুয়ারি। সুতরাং ভাষার কথা তোলাই যায়। মাতৃভাষা বা জাতীয় ভাষা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে, আরও হবে, ইত্যবসরে কিছু আলোচনা জরুরি হয়ে পড়েছে এ দেশের ‘ক্লাসিক্যাল’ বা ঐতিহ্যময় ভাষার ধারণা নিয়ে। কিছু দিন হল বার বার খবরে আসছে ক্লাসিক্যাল ভাষার বিষয়টি। কখনও বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর বলছেন, ফারসিকে ভারতের ক্লাসিক্যাল ভাষা বলে ঘোষণা করা হবে। কখনও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখছেন, বাংলাকে ক্লাসিক্যাল বা ঐতিহ্যমণ্ডিত ভাষা তালিকায় যোগ করার দাবি নিয়ে। গত তিন-চার বছর ধরে প্রবল হয়ে উঠেছে মরাঠিকে এই তালিকায় যোগ না করার বিরুদ্ধে অভিযোগ। প্রসঙ্গত স্মরণীয়, এখনও পর্যন্ত ছয়টি ভাষা ওই তালিকায় রয়েছে, তামিল, সংস্কৃত, কন্নড়, মালয়ালম, তেলুগু, ওড়িয়া। এর মধ্যে আর কোন ভাষা জায়গা পেতে পারে, তাই নিয়ে আঞ্চলিক আবেগ মাঝেমধ্যেই প্রবল বেগে প্রবহমান হয়ে ওঠে। যদিও বিষয়টির মধ্যে ভাষা ও ভাষাভাষী সংস্কৃতির কথা ধরা থাকে অনেকখানি, বড় বড় দলিল-দস্তাবেজ ঘেঁটে অনেক ইতিহাস চর্চার প্রয়াসও দেখা যায়, তবু ভাবগতিক দেখে সন্দেহ হয় বিষয়টি শেষ পর্যন্ত একেবারেই সাংস্কৃতিক বা সামাজিক নয়— ঘোরতর রাজনৈতিক। যাঁরা দাবি তোলেন, বা যাঁরা দাবি মঞ্জুর করেন, কেউই প্রকৃত প্রস্তাবে সংস্কৃতি বা সমাজ নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাতে চান না, তাঁদের সকলেরই এক ও একমাত্র আরাধ্য, রাজনৈতিক স্বার্থ।
তবে কিনা, ক্লাসিক্যাল ভাষার আয়োজনটিই তো শুরু হয়েছিল রাজনীতির গুঁতোয়। ১৮৭০-৭১ সালে ব্রিটিশ রাজ ভারতীয় ভাষাগুলিকে ঐতিহ্যময় বা ক্লাসিক্যাল আর চালু কথ্য ভাষা বা ভার্নাকুলার, এই দুই ভাগে ভাগ করে। তাতে তাঁদের নিজেদের কিছু প্রশাসনিক সুবিধা ছিল, যাকে পরোক্ষ অর্থে, এমনকি প্রত্যক্ষ অর্থেও, রাজনৈতিক ভাবনা বলাই যায়। সংস্কৃতকে তাঁরা একমাত্র ক্লাসিক্যাল ভাষার মর্যাদা দিয়েছিলেন, যার ফলে আহত তামিল অস্মিতা অশান্ত হয়ে রইল ব্রিটিশ শাসনকালে, অনেকগুলি
দশক ধরে। স্বাধীন ভারতের সংবিধান স্পষ্ট করে বলে দিল, হিন্দি আর ইংরেজি হবে দেশের ‘সরকারি’ ভাষা, কোনও ‘জাতীয়’ ভাষা থাকবে না— বাকি সব হবে তালিকাভুক্ত আঞ্চলিক ভাষা, প্রথমে যাদের সংখ্যা ছিল ১৪, পরে যা হল ২২। স্বভাবতই পূর্বজাগ্রত আহত তামিল অস্মিতা এতে শান্ত হল না। রাজনীতির গতি ক্ষুরধার, তাই ২০০৪ সালে এসে যখন আবারও ফিরতে হল ক্লাসিক্যাল ভাষার সরকারি স্বীকৃতিদানের গৌরবে, প্রথমেই ক্লাসিক্যাল ভাষা হিসাবে স্বীকৃতিটি গেল তামিলের কাছে। ক্ষোভ তুঙ্গে উঠল সংস্কৃত-মহলে। পরের বছরই বলতে হল, সংস্কৃতও ক্লাসিক্যাল ভাষা (২০০৫)। কন্নড় আর তেলুগু ক্লাসিক্যাল ভাষার শিরোপা পেল ২০০৮ সালে, মালয়ালম পেল ২০১৩ সালে, ওড়িয়া ২০১৪ সালে। ২০১৯ থেকে মরাঠি ভাষার স্বীকৃতি প্রায় ঠোঁটের ডগায় এসে আটকে আছে। মুশকিল হল, এই যদি দুনিয়াদারি হয়, তা হলে অন্যরাই বা সেই দুনিয়ায় ঠেলে-গুঁতিয়ে জায়গা করে নিতে চাইবে না কেন? ক্লাসিক্যাল ভাষা হওয়ার জন্য যা কিছু ‘কৃতিত্ব’ দরকার, এই যেমন ১৫০০-২০০০ বছরের ইতিহাস, প্রাচীন ভাষাসাহিত্য— তাতে আরও অনেক ভাষা এই প্রাচীন দেশে এই শিরোপা দাবি করতেই পারে। বাংলাও। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে সব নথিপত্র দিল্লিতে জমা দিয়েছেন তার মধ্যে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকে প্রাচীন বাংলা লিপি ও লিখিত রূপের নমুনা জায়গা পেয়েছে।
মুশকিল হল, ভারতের মতো দেশে ঐতিহ্যবাহী ভাষার দাবিটির অর্থ, গুরুত্ব ও বিশেষত্বই কি অনেকটা হারিয়ে যায় না? সকলেই যদি পূর্বপ্রজন্ম হতে চায়, তা হলে উত্তরপ্রজন্ম বলে আর কী পড়ে থাকে, সেটাই কি আবার ফিরে ভাবতে হয় না? সমস্যাটি আসলে ঔপনিবেশিক মানসিকতার উত্তরাধিকার। ক্লাসিক্যাল কাকে বলে, সেটা স্থির করা হয়েছে পশ্চিমি জ্ঞানতত্ত্বানুযায়ী। অথচ অন্য ইউরোপীয় ভাষার তুলনায় লাতিন-গ্রিক ভাষার যে স্থান, সকল ভারতীয় ভাষার ক্ষেত্রে ‘ক্লাসিক্যাল’ ভারতীয় ভাষার স্থান সে রকম কি না, প্রশ্ন তোলা জরুরি। সংস্কৃত ও তামিলের পাশে অন্য ভাষারও সেই গুরু-ত্ব আছে কি না, বোঝা জরুরি। ভাষার রাজনীতি থেকে এক বার ভাষার ইতিহাস বা নৃতত্ত্বে ফেরা শ্রেয়। অন্যথা, কালক্রমে দেশের সব ভাষাকেই ক্লাসিক্যাল বলে দিতে হবে, হাতে পড়ে থাকবে পেনসিল।