রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে আগের জমানার যা কিছুকে অস্বীকার ও বাতিলের প্রবণতা বহু-আচরিত। কিন্তু তার জেরে স্বাধীনতার মতো মৌলিক অর্জন ও তার ইতিহাসকেও কাঠগড়ায় তোলা হলে ধন্দ জাগা স্বাভাবিক: এ কি স্রেফ রাজনৈতিক বিরোধিতা, না কি আরও গভীর অসুখ কোনও? বাংলাদেশে গত অগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রায় আড়াই মাস পেরিয়েছে। এই সময়ের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের শাসনে কিছু ঘোষণা ও সিদ্ধান্ত দেখা গিয়েছে। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পালাবদলকে বলা হয়েছে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’; ‘নতুন’ দেশের শাসনতন্ত্রে নানা ‘সংস্কার’ চলছে। মনে হতে পারে, জমানা পাল্টালে তো এ রকমই হয়, এটাই স্বাভাবিক। নতুন দেশ, নতুন স্বাধীনতা ইত্যাদি শব্দগুচ্ছ সেই অর্থে সমসময়ের বাংলাদেশের ইচ্ছাপূরণের বয়ান— এত দিন যা হয়ে এসেছে, তা ছেড়ে এ বার যা হওয়া উচিত সে পথে পা রাখার ঘোষণা।
তবে দেশকে ঢেলে সাজানোর কাজ যে সহজ নয়, সেটাও এত দিনে বাংলাদেশের বিলক্ষণ জানা। তার তিপ্পান্ন বছরের ইতিহাস এমন বহু মুহূর্তের সাক্ষী যখন তাকে শুরু করতে হয়েছে প্রায় শূন্য থেকে: তা সে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর হোক বা ’৭৫-এর ১৫ অগস্ট, কিংবা ১৯৮৯-৯০’এর রাজনৈতিক অস্থিরতায় ভরা সময়টি। অর্ধশতাব্দী ধরে তাকে প্রায় সব সময়ই লড়তে হয়েছে— কখনও সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে, এবং অধিকাংশ সময়েই মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও অসাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী ধর্মীয়-রাজনৈতিক জোটশক্তির বিরুদ্ধে। এই প্রতিটি লড়াই থেকেই যদি কিছুমাত্র শিক্ষা নেওয়ার থাকে তবে তা এই— একাত্তরের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে ‘মুক্তির সংগ্রাম’ই বাংলাদেশের শিকড়, বাঙালি অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবোধ প্রতিষ্ঠার রক্ত-ঝরা পথ বেয়ে আসা স্বাধীনতাই তার গণতন্ত্রের ভিত্তি। এই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সূত্র ধরেই স্বাধীন বাংলাদেশে অল্পকালের মধ্যে সংবিধানও চালু হয়, নিঃসন্দেহে যা গৌরবের। এই সবই তার ‘ইতিহাস’, এবং তা সর্বাবস্থায় সত্য— এই রাজনৈতিক পালাবদলের সময়েও। গত পনেরো বছর আওয়ামী লীগ শাসনে দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, হুমকি-প্রথার বাড়বাড়ন্ত-সহ যত অপরাধ হয়েছে তা সেই দল, সরকার ও নেতৃত্বের চরমতম স্খলন, তার দায়ে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর আদর্শকে টেনে নামানো চলে না। এই বাংলাদেশে জেনেবুঝে তা-ই হচ্ছে কি না সন্দেহ জাগে, নইলে ৭ মার্চ, ১৫ অগস্ট বা ৪ নভেম্বরের মতো ‘ঐতিহাসিক’ দিনগুলির জাতীয় দিবস মর্যাদা বাতিল ঘোষণা হবে কেন, কেনই বা অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টার মুখে শোনা যাবে বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসাবে অস্বীকারের বিবৃতি।
রাজনৈতিক পালাবদলের আবহে বাংলাদেশে জনপরিসরে চারিয়ে গিয়েছে আরও কিছু প্রবণতা: ‘রবীন্দ্রনাথ বনাম নজরুল’ প্রসঙ্গ, জাতীয় সঙ্গীত পাল্টানো নিয়ে বিতর্ক। অবধারিত ভাবে উঠে এসেছে ধর্মীয় সংখ্যালঘুর প্রসঙ্গও: অগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পনেরো দিনে বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার ৪৯টিতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের হেনস্থার খবর উঠে এসেছে সেখানকার প্রধান সংবাদপত্রে। সম্প্রতি দুর্গাপূজা সম্পন্ন হয়েছে সেনার কড়া নিরাপত্তায়, তবু কয়েকটি জায়গায় মণ্ডপে মূর্তি ভাঙচুর ও হামলার ঘটনা অঘটিত থাকেনি। বোঝা যায়, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান যতই সব জাতি ধর্ম গোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা বলুন না কেন, রাজনৈতিক অপশক্তি ও তার সমর্থকরা অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে ক্ষমতায় আসতে বদ্ধপরিকর। দেশ এই ২০২৪-এ স্বাধীন হল, এ বার লেখা হবে নতুন ইতিহাস, তাদের এই ঘোষণা হালকা ভাবে নেওয়ার সমূহ বিপদ আছে: তপ্ত কটাহ থেকে জ্বলন্ত চুল্লিতে গিয়ে পড়ার বিপদ, এত বছরের অর্জন ধূলিসাৎ হওয়ার বিপদ। এই বিপদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে প্রতিবেশী দেশ।