মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
শিল্পে বিনিয়োগ আনিতে এবং শিল্প প্রতিষ্ঠায় পশ্চিমবঙ্গ কতটা সফল, তাহা বুঝিবার পক্ষে ২০২২ সালটি গুরুত্বপূর্ণ। বিধানসভা নির্বাচনে তৃতীয় বার জয়ী হইবার পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করিয়াছেন, সামাজিক উন্নয়নকে গুরুত্ব দিবার পরে এ বারে রাজ্য সরকার শিল্পায়নের প্রতি মনোনিবেশ করিবে। বিবিধ শিল্পকে উৎসাহ দিবার প্যাকেজ বা প্রকল্পগুচ্ছ ঘোষণা করিবার আশ্বাসও দিয়াছেন। আগামী এপ্রিল মাসে রাজ্যে আবার একটি বিশ্ব বাণিজ্য সম্মেলন বসিবে, বৃহৎ শিল্পপতিরা তাহার আমন্ত্রণ গ্রহণ করিয়া আগ্রহ বাড়াইবেন, এমন সম্ভাবনা প্রবল। অনুরূপ সম্মেলন পূর্বেও হইয়াছে। রাজ্য সরকারের মতে, ২০১৫-১৯ সময়পর্বে শিল্প সম্মেলনগুলিতে অন্তত বারো লক্ষ কোটি টাকার শিল্প-প্রস্তাব আসিয়াছে, যাহার একটি বড় অংশ সরাসরি রাজ্যে বিনিয়োগ হইবার কথা। সংখ্যাটি আশ্বস্ত করিবার মতো, কিন্তু বাস্তবে শিল্প উৎপাদন এবং কর্ম নিযুক্তির হাল আশ্বাস এবং প্রত্যয়ের দূরত্ব ঘুচাইতে সাহায্য করে না। রাজ্যবাসী শিল্প-বিনিয়োগের আশ্বাসকেও অপরাপর রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির মতোই ভাবিতে অভ্যস্ত হইয়াছেন। কিন্তু এখন শিয়রে শমন উপস্থিত— খাদ্যসাথী, স্বাস্থ্যসাথী, কৃষকবন্ধু, লক্ষ্মীর ভান্ডার-সহ বিবিধ সহায়তা প্রকল্পে যে বিপুল ব্যয় হইতেছে, তাহার জন্য প্রভূত অর্থের প্রয়োজন। বিরোধীদের অভিযোগ, রাজ্যের বাজেট ঘাটতি আশঙ্কাজনক ভাবে বাড়িতেছে। ২০১৯-২০ সালে ঘাটতি ছিল ছত্রিশ হাজার কোটি টাকা, চলতি অর্থবর্ষের শেষে ষাট হাজার কোটি টাকাও ছাড়াইয়া যাইবে। কেবল কর সংগ্রহ বাড়াইয়া এই বিপুল ঘাটতি মিটিবে না, প্রশাসন চালাইবার খরচ এবং বিবিধ প্রকল্পের ব্যয় বহন করা কঠিন হইবে। শিল্পোৎপাদনে উন্নতি রাজস্ব বাড়াইবার একমাত্র পথ। তাহার সুফল মিলিতে সময় লাগিবে, কিন্তু তাহাই স্থায়ী সমাধানের একমাত্র পথ। অতএব কেবল উন্নয়নের বৃহত্তর স্বার্থেই নয়, রাজ্য কোষাগার চালাইবার প্রত্যক্ষ স্বার্থেও শিল্প-বিনিয়োগ অত্যাবশ্যক। অপরাপর রাজ্যের সহিত প্রতিযোগিতা করিয়া শিল্প আনিতে হইবে পশ্চিমবঙ্গকে।
সুতরাং এই বৎসর বাণিজ্য সম্মেলনে বৃহৎ শিল্পপতিরা থাকিলে উত্তম। কিন্তু তাহার পরেও শিল্প প্রতিষ্ঠা, অধিক কর্মনিযুক্তি হইতে অধিক রাজস্ব সংগ্রহে বৃদ্ধির দীর্ঘ পথ হাঁটিতে হইবে রাজ্যকে। গত কয়েক বৎসরে কিছু তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা এবং সিমেন্ট সংস্থা ব্যতীত নূতন শিল্প তেমন হয় নাই। কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য অনুসারে, প্রস্তাবিত বিনিয়োগের অঙ্কের নিরিখে (ইন্ডাস্ট্রিয়াল অন্ত্রেপ্রেনিয়র মেমোরান্ডাম) কর্নাটক, গুজরাত ও মহারাষ্ট্রের বহু পশ্চাতে পশ্চিমবঙ্গের স্থান। একটি শুভ ইঙ্গিত: পরিকাঠামোর উন্নয়নে বিবিধ প্রকল্প গ্রহণ করিয়াছে সরকার। জলপথ এবং সড়কপথ সংস্কারের দুইটি বৃহৎ পরিকল্পনা গ্রহণ করিয়াছে কেন্দ্র ও রাজ্য। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের সংখ্যায় পশ্চিমবঙ্গ শীর্ষে— যেখানে নিয়োগের সম্ভাবনা সর্বাধিক— বর্তমানে এক কোটিরও উপর নাগরিক এই শিল্পগুলিতে কর্মরত। পশ্চিমবঙ্গে শিল্পের এমন নানা সম্ভাবনার কথা অজানা নহে।
কিন্তু সমস্যার দিকগুলিও সুবিদিত। শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণে রাজ্য সরকারের অনিচ্ছা তাহার অন্যতম। কেন্দ্রের সহিত রাজ্যের বিবিধ অহেতুক সংঘাতও বিনিয়োগের সহায়ক নহে। রাজ্যের পুরাতন বৃহৎ শিল্পগুলির প্রতিও সরকারের মনোযোগ আবশ্যক। চট এবং চা, এই দুইটি শিল্পের ক্রমে অবনতি হইয়াছে। ইস্পাত উৎপাদনেও রাজ্য তাহার পূর্বের ভূমিকা হারাইয়াছে। বহু শিল্পের প্রধান দফতর সরিয়াছে কলিকাতা হইতে। শিল্পোৎসাহী মানুষ রাজ্যে কম নাই, দক্ষ শ্রমিকও রহিয়াছে। অথচ, রাজনৈতিক সংস্কৃতি দীর্ঘ দিন শিল্পের পথ রোধ করিয়া দাঁড়াইয়াছে। তৃতীয় তৃণমূল কংগ্রেস সরকার কি মোড় ঘুরাইতে পারিবে?