Mamata Banerjee

‘ফেরা’র উপদেশ

মুখ্যমন্ত্রী যে উৎসবে ফেরার আহ্বান জানিয়েছেন, তা কি নিতান্তই এক শারদ সমাপতন? এই আহ্বানের মধ্যেই কি বর্তমান জমানার একটি গুরুত্বপূর্ণ শাসনকৌশল নিহিত নেই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৭:৫৮
Share:

হীরকরাজ্যে ‘ভরসাফুর্তি’ উৎসবকে কেন্দ্র করে কী পরিণাম ঘনিয়ে এসেছিল, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সম্ভবত সে কথাটি ভুলে গিয়েছেন। যে ভঙ্গিতে তিনি মানুষকে উৎসবে ফেরার উপদেশ দিয়েছেন, তাতে নাগরিক সমাজের ক্ষোভের বিস্ফোরণ প্রত্যাশিতই ছিল। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যটি শুনলে মনে হতে পারে যে, তিনি যেন সমাজকে তাঁর অনুমতির সীমা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন: এক মাস তিনি আন্দোলন সহ্য করেছেন, আর নয়। এ বার সমাজ ফের উৎসবে গা ভাসিয়ে দিক, রাজনীতির প্রশ্নগুলিকে ছেড়ে দিক রাজনীতিকদের হাতেই। মুখ্যমন্ত্রী বিস্মৃত হয়েছেন, অথবা, হয়তো তিনি জানেনই না যে, নাগরিকের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় পদাধিকারীদের সম্পর্কটি কর্তৃত্ববাচক নয়, প্রভু-ভৃত্যের নয়। রাষ্ট্র অনুরোধের ছলে হুকুম করবে, আর বাধ্য নাগরিক ভক্তিতে অথবা ভয়ে সেই হুকুম মেনে পা ফেলবে, গণতন্ত্র এমন অধিকার রাষ্ট্রকে দেয় না। গণতন্ত্রে নাগরিক তাঁর নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারী। যাঁর উৎসবে অংশগ্রহণ করার, তিনি তাতে যোগ দেবেন; যাঁর কাছে এখন উৎসবের অংশীদার হওয়া কাম্য নয় বা সম্ভব নয়, তিনি দূরে থাকবেন, যাঁরা বাঙালির বৃহত্তম উৎসবের পরিসরটিকেই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রতিবাদ জারি রাখার জন্য ব্যবহার করতে চাইবেন তাঁরা সেটাই করবেন। সংবিধানস্বীকৃত অধিকারের গণ্ডির মধ্যে নাগরিক যাতে অবাধে প্রতিবাদ জানাতে পারেন, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের, সেই প্রতিবাদ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে হলেও। অনুরোধের মোড়কে উৎসবে ফেরার অনুজ্ঞাটি গণতন্ত্রের চরিত্রবিরোধী। মুখ্যমন্ত্রী ইতিহাসের একটি সত্য স্মরণে রাখতে পারেন— রাষ্ট্রীয় পেশিশক্তির জোরে নাগরিক ক্ষোভকে দমন করার একাধিপত্যবাদী ভঙ্গিটি শেষ অবধি সর্বত্র পরাজিত হয়, এটাই ইতিহাসের শিক্ষা।

Advertisement

মুখ্যমন্ত্রী যে উৎসবে ফেরার আহ্বান জানিয়েছেন, তা কি নিতান্তই এক শারদ সমাপতন? এই আহ্বানের মধ্যেই কি বর্তমান জমানার একটি গুরুত্বপূর্ণ শাসনকৌশল নিহিত নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বঙ্গের মসনদে আসীন হওয়ার পরে এ রাজ্যে ‘উৎসব’-এর বাহুল্য চোখে পড়ার মতো। দুর্গাপুজো ও কার্নিভ্যালের মতো বড় উৎসব তো বটেই, রাজ্যের কার্যত প্রতিটি প্রান্তে সম্বৎসর বিবিধ উৎসব, মেলা, পুজোকে কেন্দ্র করে জনসমাগম চলতেই থাকে। তার পাশাপাশি রয়েছে যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা হরেক মাপের বিনোদন-পার্ক, খাবারের দোকান, আলো, প্রাচীন বৃক্ষরাজি কেটে তৈরি করে দেওয়া কৃত্রিম প্রমোদকানন। অনুমান করা চলে, শাসকরা আশা করেন যে, মানুষের জন্য যদি অবিরাম বিনোদনের ব্যবস্থা করে রাখা যায়, তা হলে হয়তো তাঁদের ভিতরের ক্ষোভগুলি প্রশমিতই থাকবে, বিস্ফোরণ ঘটবে না কখনও। মুখ্যমন্ত্রী সম্ভবত সেই মডেলটি অনুসরণ করেই রাজ্যবাসীকে উৎসবে ফিরতে বলেছেন— তিনি ধরেই নিয়েছেন, উৎসবের প্রমোদে মন ঢেলে দিলে এই পুঞ্জীভূত ক্ষোভ আপনি মিলিয়ে যাবে। তবে, শাসকরা যে কথাটি বারে বারেই ভুলে যান, তা হল: “কখন কী ভাবে বিস্ফোরণ ঘটবে এবং তা কে ঘটাবে সে সম্বন্ধে জানতে রাষ্ট্রযন্ত্রের এখনও বাকি আছে।”

রাজ্যবাসী বরং মুখ্যমন্ত্রীকে বলতে পারেন: এক মাস হয়ে গেল, এ বার রাজধর্মে ফিরুন। একটি হত্যাকে কেন্দ্র করে কেন এই অভূতপূর্ব ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটল, তা বোঝার চেষ্টা করুন। রাজনৈতিক চেষ্টা নয়, ফাঁক খোঁজার কৌশলসন্ধান নয়, আন্তরিক ভাবে চিন্তা করুন, তাঁর শাসনকে নাগরিক সমাজ এ ভাবে ‘অবৈধ’ ঘোষণা করছে কেন। সত্যিই যদি মানুষের ক্ষোভের প্রকৃত কারণ খোঁজেন, মুখ্যমন্ত্রী বুঝবেন— সর্ব স্তরে দলীয় দুর্নীতি, সিন্ডিকেট-রাজ, খাজনা আদায়ের অনিবার্যতা এবং অত্যাচারে মানুষ নাজেহাল। সরকারের কাছে ন্যায্যতার ন্যূনতম প্রত্যাশাটুকুও আর নেই। এই অনাস্থাকে অতিক্রম করার একমাত্র পথ রাজধর্মে ফিরে আসা। সেই কঠিন পথে হাঁটার মতো জোর মুখ্যমন্ত্রীর আছে কি?

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement