Panihati

বিবেচনাহীন

গরমে ও ভিড়ে অসুস্থ হয়ে লুটিয়ে পড়লেন তিন জন, তাঁদের উপর দিয়ে চলে গেল দিশাহারা মরিয়া জনস্রোত, যা প্রশাসনকে দিয়ে গেল মোক্ষম বার্তা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৭ জুন ২০২২ ০৫:০৭
Share:

অসহ্য গরম, চরম অস্বস্তিকর আবহাওয়া, মাত্রাছাড়া ভিড়, অসুস্থতা, মৃত্যু। ঠিক এই কার্য-কারণ পরম্পরায় পানিহাটি দণ্ড মহোৎসবে তিন পুণ্যার্থীর প্রাণহানিকে ব্যাখ্যা করেছে প্রশাসন। যে কথাটি বলেনি, সেটি নিজেদের ব্যর্থতার কথা। প্রশ্নের আঙুল কিন্তু উঠেছে অবধারিত ভাবেই: এমন গরমও এক দিনে পড়েনি, এই ভিড়ও অপ্রত্যাশিত ছিল না। তা হলে এই দুইয়ের মোকাবিলায় যা যা করা উচিত ছিল, তা হল কোথায়? আরও গোড়ার কথা: জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রবল গরমেও উৎসবমুখী গলিপথে লক্ষ লোকের যাতায়াত চলবে, এই অবস্থাতে অসুস্থতা ও পদপিষ্ট হওয়ার পরিস্থিতিও অসম্ভব নয়, তাই প্রশাসনের তরফে উপযুক্ত ব্যবস্থা আগেই করা দরকার— সেই ভাবনাটা কোথায়? গরমে ও ভিড়ে অসুস্থ হয়ে লুটিয়ে পড়লেন তিন জন, তাঁদের উপর দিয়ে চলে গেল দিশাহারা মরিয়া জনস্রোত— তিনটি নাগরিকমৃত্যু প্রশাসনকে দিয়ে গেল সেই মোক্ষম বার্তা: “ভাবো, ভাবো, ভাবা প্র্যাকটিস করো।”

Advertisement

কিন্তু সে তো ভাববে না বলেই পণ করেছে। অতিমারিতে দু’বছর ‘নিয়ন্ত্রিত’ থাকার পরে উৎসব স্বমহিমায় ফিরছে, তার জেরে বিপুল জনসমাগম, অসুস্থতা ও দুর্ঘটনার আশঙ্কার কথা তার মাথায় আসবে না? কিছু দিন আগের নজরুল মঞ্চের দুর্ঘটনার সঙ্গে পানিহাটির ঘটনার মিল কেবল দু’জায়গার মাত্রাতিরিক্ত গরম ও ভিড়েই নয়, ব্যবস্থাপকদের চরম অব্যবস্থাতেও। মনে রাখা দরকার, পানিহাটি মহোৎসবের মূল ব্যবস্থাপক স্থানীয় পুরসভা। এই নাগরিকমৃত্যুর দায়, প্রশাসনের অদূরদর্শিতার ‘অপরাধ’ তারা এড়াতে পারে না। দুর্ঘটনার পরে মৃতদেহ বাড়ি পৌঁছনোরও আগে ত্বরিত গতিতে ক্ষতিপূরণ পৌঁছেছে, উদ্যোক্তারা বলছেন পরের বার পুণ্যার্থীদের স্বস্তি দিতে জল ছিটাবেন, এই তৎপরতা ও পূর্বভাবনার কিয়দংশ থাকলে সম্ভবত তিনটি প্রাণ চলে যেত না। পুলিশ, স্বেচ্ছাসেবক, নাগরিক গোষ্ঠীর সাহায্য নিয়ে, জলসত্র বিশ্রামস্থল ও আপৎকালীন চিকিৎসা পরিষেবা নিশ্চিত করে উৎসবের পরিকাঠামো নিখুঁত নিশ্ছিদ্র করা যেত। তা হয়নি। কারণ: এই প্রশাসন দূরদৃষ্টিহীন। কারণ: ইদানীং কালে তার প্রতি পদে— শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, নাগরিক পরিষেবায়— অবহেলা, গাফিলতি ও গয়ংগচ্ছ মনোভাবের যে সামগ্রিক প্রবণতাটি দগদগে, ঐতিহ্যবাহী মহোৎসবও তার ব্যতিক্রম নয়।

‘ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না’ মূলমন্ত্র কি শুধু প্রশাসনেরই স্মর্তব্য? নাগরিক নিজে কি কাজে লাগাবেন না তাঁর সামাজিক ঔচিত্যবোধ? ঐতিহ্যবাহী মহোৎসবে গত দু’বছর যাওয়া যায়নি বলে, কিংবা স্রেফ পুণ্য হবে বলে ছুটে যাবেন সম্ভাব্য বিপদভূমিতে? সরকার তথা প্রশাসনের বহু গাফিলতির পাশে নাগরিকের চরম অসচেতনতার ছবিটিও এ রাজ্যে প্রকট— কোভিড-আবহে দুর্গাপুজো, জগদ্ধাত্রী পুজো বা গঙ্গাসাগর মেলার বেলাগাম ভিড় তার সাক্ষী। এই অপরিণামদর্শী হুজুগও এক অপরাধ। নাগরিককে বুঝতে হবে, তাঁর ব্যক্তিস্বাধীনতা ও ধর্মাচরণের স্বীকৃত অধিকারেরও উপরে তাঁর জীবনের অধিকার, সেই অধিকার নিশ্চিত করতে তাঁর নিজ দায়িত্বও কম নয়। এই দায়িত্ব যত না ‘করা’র, তারও বেশি ‘ভাবা’র: কখন কী করা দরকার, কোন কাজটি না করলেই ভাল। প্রাণ চলে যাচ্ছে, আর কবে ‘ভাবা প্র্যাকটিস’ শুরু করবেন এ রাজ্যের নাগরিকেরা?

Advertisement

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তেফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement