পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান আপাতত জামিন পেয়ে বাড়ি ফিরেছেন। ফাইল ছবি।
দুর্নীতির অভিযোগের মতো হাতিয়ার হাতে থাকলে প্রতিহিংসার রাজনীতির পোয়াবারো। ভারতে যেমন এ দৃশ্য নিত্য দেখতে দেখতে প্রায় চোখ-সওয়া হতে বসেছে,ভারতীয় উপমহাদেশেও। পড়শি দেশ পাকিস্তানও এক চরম কুনাট্য উপহার দিয়ে গেল এই একই অস্ত্রে শাণ দিয়ে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগকে বিন্দুমাত্র খাটো না করেও বলা যায়, যে ভাবে সম্প্রতি তাঁকে আদালতের সামনে থেকে গ্রেফতার করা হল, সেটা আঁতকে ওঠার মতোই। বস্তুত এই গ্রেফতারি যে বেআইনি, পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টই দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সেই রায় দিয়েছে। ইমরান খান আপাতত জামিন পেয়ে বাড়ি ফিরেছেন। সোমবার অবধি গ্রেফতারি থেকে তাঁর রক্ষাকবচ রয়েছে। প্রশ্নটা এখানে এই নয় যে, ইমরান খান দুর্নীতি করেছেন কি করেননি। নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে অবশ্যই তার তদন্ত ও বিচার হবে যথাবিধি। কিন্তু ক্ষমতাসীন শাসক যখন ছলে-বলে-কৌশলে বিরোধী স্বরকে দমন করার কাজে ‘দুর্নীতি’কে ঢাল করতে থাকে, তখন গণতন্ত্রের পক্ষে তার ফল হয় মারাত্মক।
পাকিস্তানে প্রাক্তন রাষ্ট্রপ্রধানদের ‘করুণ’ পরিণতির ইতিহাস অবশ্য অনেক দিনের। ইমরান খানের এই দুর্গতি সেই পরম্পরাতেই নতুন সংযোজন মাত্র। পাক রাষ্ট্রনীতিতে সামরিক বাহিনীর ছড়ি ঘোরানো বন্ধ না হলে এই রেওয়াজে দাঁড়ি পড়াও কঠিন। বস্তুত সেনাবাহিনীর সমর্থন ছাড়া পাকিস্তানে ক্ষমতায় আসা এবং ক্ষমতায় টিকে থাকা কার্যত অসম্ভব। যিনি যখন ক্ষমতা পাচ্ছেন, সেনার বরাভয় সঙ্গে নিয়েই তিনি তা পাচ্ছেন। তখন তাঁর পক্ষে সেনাকে চটানো মুশকিল শুধু নয়, অসম্ভবই বলা চলে। কালেদিনে সেই বরাভয় হস্ত সরে গেলে তাঁর পতনের রাস্তা প্রশস্ত হচ্ছে। ক্ষমতাচ্যুত অবস্থায় তিনি যখন সেনার ভূমিকা নিয়ে মুখ খুলছেন, যেমন ইদানীং ইমরান, তাতে কাজের কাজ খুব কিছু হচ্ছে না। কারণ সেনার দাক্ষিণ্য তত ক্ষণে অন্যের উপর বর্ষিত হতে শুরু করেছে। ইমরান খান যেমন দাবি করছেন, তাঁর আকস্মিক গ্রেফতারির পিছনে মূল মস্তিষ্ক সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের। ইমরানের সমর্থকেরা লাহোরের এক সেনা অফিসারের বাড়িতে হামলাও করেছেন। উল্টো দিকে ইমরান খানের বিরোধীরা বলছেন, ইমরানের ‘দুর্নীতি’ ফাঁস করার ক্ষেত্রে আসিমের বড় ভূমিকা ছিল। সে কারণেই তিনি ইমরানের চক্ষুশূল। দাবি-পাল্টা দাবির এই ঘূর্ণিপাকে না গিয়েও এটুকু বলা যায়, কেউ যদি দুর্নীতি করে থাকেন, আইন-আদালতের পথেই তাঁর বিচার হওয়ার কথা। সেনাবাহিনী যদি সর্বক্ষণ প্রশাসনের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলে এবং প্রশাসনের নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে, সেটা গণতন্ত্র তো নয়ই, গণতন্ত্র-বেশী রাজনীতি হিসাবেও তা ব্যর্থ। এই ছদ্ম-গণতন্ত্র পাকিস্তান বহন করে চলেছে দশকের পর দশক ধরে। তাতে তার নিজের লাভ তো হয়নি বটেই, প্রতিবেশী হিসাবে ভারতেরও মাথাব্যথার কারণ থেকে গিয়েছে বিস্তর।
সেই সঙ্গে মনে রাখা ভাল, পাকিস্তানে এই রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে এমন একটা সময়ে, যখন সে দেশের অর্থনৈতিক বিপর্যয় চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষেরা গত এক বছর ধরে পারস্পরিক বিষোদ্গারে যত সময় ব্যয় করেছেন, অর্থনীতির হাল ফেরানোর চিন্তা তত করেছেন কি না সন্দেহ। আসন্ন নির্বাচনই আপাতত তাঁদের পাখির চোখ। কিন্তু আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার যদি সদয় না হয়, তা হলে তার আগেই ঋণের ফাঁদে পুরোপুরি ডুবে যেতে পারে দেশ। কোষাগারের হাল শোচনীয়, পাক মুদ্রার দাম তলানিতে। এমতাবস্থায় আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক মহলের আস্থা ফেরানোর চেষ্টা করাই হতে পারত রাজনীতিকদের প্রধান কর্তব্য। উল্টে দেশ জুড়ে অশান্তি, বিশৃঙ্খলা তাঁদের আরও খাদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। পাকিস্তানের নাগরিক সমাজের হাতে বিশেষ ক্ষমতা নেই, সেটা সকলেরই জানা। রাজনৈতিক সমাজ পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝবে কি না, এটাই প্রশ্ন।