ফুটবল-বিশ্বে নিজেদের ওজন বাড়াতে জলের মতো অর্থব্যয় করেছে কাতার। ফাইল চিত্র।
বিশ্বকাপ ফুটবলের এই শেষবেলায় একটা গোড়ার প্রশ্ন তোলা যাক— কাতার বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজন করতে চাইল কেন? আপাতদৃষ্টিতে উত্তরটি সহজ— কোন দেশই বা এমন উৎসবের কেন্দ্র হতে না চায়? প্রকৃত প্রস্তাবে প্রশ্নটি জটিলতর। ফুটবল-খেলিয়ে দেশ হিসাবে কাতার খ্যাতিমান নয়। সবাইকে অবাক করে কাতার যখন বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব পেল, তখন সে দেশে ফুটবল পরিকাঠামোও বলার মতো ছিল না। ২২,০০০ কোটি ডলার ব্যয় করে কাতার গত দশ বছরে গোটা দেশকেই কার্যত পাল্টে ফেলেছে। রেল, সড়ক, স্টেডিয়াম, হোটেল, সবই তৈরি হয়েছে বিশ্বকাপের কথা মাথায় রেখে। খরচের অঙ্কটা ঠিক কতখানি, আগের বিশ্বকাপগুলির সঙ্গে তুলনা করলে তার আঁচ পাওয়া যেতে পারে। ২০১৪ সালে ব্রাজিল খরচ করেছিল ১৫০০ কোটি ডলার, ২০১৮ সালে রাশিয়ার ব্যয় ছিল ১১৬০ কোটি ডলার। সম্ভবত, আগের সব ক’টি বিশ্বকাপের খরচের অঙ্ক— মূল্যবৃদ্ধির হিসাব মাথায় রেখে— কষলেও কাতারের ব্যয়ের নাগাল পাওয়া যাবে না। ফুটবল-বিশ্বে নিজেদের ওজন বাড়াতে জলের মতো অর্থব্যয় করেছে কাতার— ফরাসি ফুটবল দল প্যারিস সঁ জরমঁ-কে কিনে নিয়েছে কাতারের পুঁজি, বিপুল বিনিয়োগ করেছে ইউরোপের ফুটবল লিগে, ক্রীড়া মিডিয়ায়। দেশের কঠোর ইসলামিক অনুশাসনকে শিথিল করেছে কাতার। নির্দিষ্ট এলাকায় বিয়ার পানের অনুমতি মিলেছে, মহিলাদের পোশাকের ক্ষেত্রেও আরব দেশসুলভ কঠোরতা নেই। মোট কথা, একটা বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে কাতার বহু স্তরে পাল্টে ফেলল নিজেকে। অবশ্য অনেক স্তরে বদলায়নিও বটে— সমকামিতা সম্বন্ধে রাষ্ট্রীয় নীতিই হোক, বা পরিযায়ী শ্রমিকদের মানবাধিকার রক্ষায় সামুহিক ব্যর্থতা, কাতার রয়ে গিয়েছে তার পুরনো অবস্থানেই।
প্রশ্ন হল, একটা ক্রীড়া প্রতিযোগিতার জন্য এই রাজসূয় যজ্ঞ কেন? এক কথায় উত্তর, প্রতিযোগিতার নাম বিশ্বকাপ ফুটবল। কাতার নামক দ্বীপরাষ্ট্রটি মাত্র পঞ্চাশ বছর আগেও নিতান্ত নিস্তরঙ্গ এক ভূখণ্ড ছিল, যার পরিচিতি বলতে ছিল সমুদ্র মুক্তো তোলার পেশা। সত্তরের দশকের গোড়ায় সেখানে খোঁজ মিলল পেট্রোলিয়ামের বিপুল সম্ভারের— আলিবাবার গুহার দরজা খুলল। কিন্তু, তার পরও দুই প্রতিবেশী সৌদি আরব আর সংযুক্ত আরব আমিরশাহির সঙ্গে জৌলুসে, বৈভবে, প্রতাপে এবং প্রভাবে তুলনীয় হতে পারেনি কাতার। বিশ্বকাপ ফুটবল হল সেই প্রদীপের দৈত্য, যার পক্ষে সম্ভব কাতারকে এক ধাক্কায় আন্তর্জাতিক গুরুত্বের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসা। গত এক মাস সাক্ষী, সেই উদ্দেশ্য বহু দূর অবধি সফল হয়েছে। বিশ্বকাপ কাতারের ভাবমূর্তিকে অনেকখানি পাল্টাতে পেরেছে। প্রবলতর প্রতিবেশীদের ছায়ায় নয়, কাতারকে এ বার নিজের পরিচয়েই বিশ্বসভায় উপস্থিত হওয়ার ছাড়পত্র জোগাড় করে দিচ্ছে ফুটবল।
পাল্টে দিতে পারাই অবশ্য ফুটবলের ধর্ম। এই বিশ্বকাপে ইউরোপের একাধিক দলে চোখে পড়ার মতো সংখ্যায় খেলছেন অভিবাসী ফুটবলাররা। তাঁদের মধ্যে কেউ অভিবাসী পরিবারের দ্বিতীয় প্রজন্ম, কেউ উদ্বাস্তু, কেউ শুধু ফুটবলের টানেই দেশ ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন নতুন দেশে। এই বিশ্বকাপে এমন মোট ১৩৬ জন খেলোয়াড় যোগ দিয়েছেন, যাঁরা জন্মভূমির নয়, অন্য কোনও দেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন। নতুন ঠিকানা হয়ে ওঠা দেশের মধ্যে যেমন ফ্রান্স আছে, তেমনই আছে মরক্কোও। সবাইকে চমকে দিয়ে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ওঠা এই আফ্রিকান দেশটির প্রতিনিধি হিসাবে মাঠে নামা খেলোয়াড়দের অনেকেই জন্মসূত্রে ফরাসি, ওলন্দাজ বা স্পেনীয়। ফ্রান্সের জাতীয় দলের হয়ে ১০০টি ম্যাচ খেলেছেন, এমন ন’জন খেলোয়াড়ের মধ্যে পাঁচ জনই জন্মসূত্রে অ-ফরাসি। গোটা ইউরোপ জুড়ে যখন অভিবাসী-বিদ্বেষী দক্ষিণপন্থী রাজনীতির প্রবল প্রতাপ, তখন এমন ঘটনার তাৎপর্য বাড়িয়ে বলার উপায় নেই। এবং, এই সূত্র ধরে কেউ অন্য এক পাল্টে যাওয়ার স্বপ্নও দেখতে পারেন। ঘটনা হল, যাঁরা ফুটবলভক্ত, তাঁদের একটা বড় অংশ দক্ষিণপন্থী উগ্রতারও সমর্থক। দেশের অভিবাসী-বহুল ফুটবল দলের সাফল্য উদ্যাপন করতে করতে তাঁদের অনেকেই হয়তো টের পেতে পারেন যে, দেশকে ভালবাসার সঙ্গে কোনও নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর প্রতি বিদ্বেষের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। হয়তো ফুটবলই তাঁদের ঘৃণাহীন জাতীয়তাবাদে দীক্ষা দিতে পারে। এমন স্বপ্ন দেখাতে পারে বলেই তো গোটা দুনিয়া ফুটবলে মেতে ওঠে।