— ফাইল চিত্র।
পুরনো সংবাদপত্রের পাতা ঘাঁটতে বসলে কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশের ২০১১ সালের একটি মন্তব্য খুঁজে পাওয়া যাবে— ‘কংগ্রেস কোনও এনজিও নয়, একটি রাজনৈতিক দল’। ১৩ বছর দীর্ঘ সময়। তার মধ্যে কংগ্রেসের চরিত্রের বিবর্তন ঘটে গেল কি না, রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মনে স্বভাবতই এই প্রশ্ন আসতে পারে। লোকসভা ভোটের দিন ঘোষণা হয়ে গেল, কংগ্রেসের এখনও প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত হল না। ইন্ডিয়া জোটের সাবেক শরিকদের মধ্যে যে দু’চারটি দল এখনও রয়ে গিয়েছে, তাদের সঙ্গে আসন সমঝোতাও হল না। দলের নেতা রাহুল গান্ধী সবে তাঁর ন্যায়যাত্রা শেষ করলেন— সে এমনই যাত্রা, যার সমাপ্তি সংবাদে টের পাওয়া গেল যে, তা চলছিল। ২০২২ সালের ভারত জোড়ো যাত্রার উদ্দীপনার তিলমাত্র তাতে পাওয়া গেল না, মানুষের কাছে সাড়াও মিলল সেই অনুপাতেই। ফলে, কংগ্রেস কোনও এনজিও বা অসরকারি জনকল্যাণ সংস্থা কি না, তা নিয়ে বিস্তর সংশয় থাকলেও, এটিকে আর কোনও মতেই রাজনৈতিক দল বলে ভুল করার উপায় নেই। কারণ, এ দেশে রাজনৈতিক দল যেগুলি, তারা ভোটযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে সর্বশক্তিতে। যে কোনও প্রশ্নকেই নিজেদের পক্ষে রাজনৈতিক অস্ত্রে পরিণত করছে। ঠিক এই সময়ে কংগ্রেসের নেতারা ইস্তাহারের দ্বিতীয় দফা প্রকাশ করে দায় সেরেছেন; মুম্বইয়ের শিবাজি পার্কে ন্যায়যাত্রার সমাপ্তি উপলক্ষে ইন্ডিয়া-র শরিক দলগুলির দু’তিন জন নেতার সঙ্গে ছবি তুলেই ভেবে নিয়েছেন যে জোট সফল। হারার আগে হেরে যাওয়ার এমন উদাহরণ ইতিহাসে ঠাঁই পাওয়ার যোগ্যই বটে।
পরিবারতন্ত্র এখন ভারতীয় রাজনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি, অতএব কংগ্রেসের গান্ধী পরিবার-নির্ভরতাকে আলাদা ভাবে দোষ দেওয়ার উপায় নেই। কিন্তু, কংগ্রেসের মূল সমস্যা কোথায়, তা নির্দেশ করতে হলে রাহুল গান্ধীর দিকে আঙুল তুলতেই হবে। দল তাঁর মুখাপেক্ষী, অথচ তিনি নেতৃত্ব বলতে কী বোঝেন, সেটাই এত দিনেও স্পষ্ট হল না। ন্যায়যাত্রার কথা নাহয় উহ্যই থাকুক, তাঁর সফল ভারত জোড়ো যাত্রাটি থেকেও কি তিনি যথেষ্ট রাজনৈতিক লাভ আদায় করতে পেরেছেন? ঘৃণার বাজারে মহব্বতের দোকান খোলার কথাটি শ্রুতিমধুর, কিন্তু শেষ অবধি কি সেই প্রতিস্পর্ধী সম্প্রীতির রাজনীতি তিনি তৈরি করতে পারলেন? যাত্রার কোন বার্তাটি কংগ্রেসের হাতে রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারল? এই মুহূর্তে নির্বাচনী বন্ডের প্রশ্নটিকেও তিনি বিজেপির বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে ব্যর্থ— তাঁর বক্তব্য বরং বুমেরাং হয়ে ফেরত আসছে। সিএএ নিয়ে তাঁর নীরবতাতেও স্পষ্ট যে, কোনও প্রশ্নকে কী ভাবে রাজনীতির পরিসরে ব্যবহার করতে হয়, সে দক্ষতা তিনি এখনও অর্জন করে উঠতে পারেননি।
ভারত জোড়ো যাত্রার পর্বটি বাদ দিয়ে দেখলে বলতে হয়, কোনও এক আশ্চর্য কারণে সব কংগ্রেস নেতারাই ধরে নিয়েছেন, সমাজমাধ্যমে দিনে দু’বার পোস্ট করাই রাজনীতির পরাকাষ্ঠা, রাস্তায় নেমে লড়াই করার সমতুল বিকল্প। ফলে, যে কোনও প্রশ্নেই তাঁরা সমাজমাধ্যমে বক্তব্য পেশ করেন। অথবা, চমৎকার সব ইস্তাহার রচনা করে দল। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে সামাজিক ন্যায়ের উপর ভিত্তি করে রচিত কংগ্রেসের ইস্তাহারটিই সবচেয়ে মনোগ্রাহী, অর্থপূর্ণ এবং সর্বজনীন উন্নয়নমুখী ছিল। আবার সেই চমৎকার ইস্তাহার কত আসন দিতে পারে, গত নির্বাচনই তার অকাট্য প্রমাণ পেশ করেছে। এ বারও কংগ্রেস খাসা ইস্তাহার রচনা করছে। সেই ইস্তাহারে যে প্রতিশ্রুতি আছে, তাকে সাধারণ মানুষের কাছে তাদের বোধগম্য ভাষা ও ভঙ্গিতে না পেশ করতে পারলে যে সেই অক্ষরমালার তিলমাত্র দাম নেই, এ কথাটি কংগ্রেসকে বুঝিয়ে বলবে কে? পথে না নামতে চাইলে দল তো নয়ই, এনজিও হওয়াও কঠিন। তার চেয়ে বরং থিঙ্কট্যাঙ্ক হয়ে ওঠার কথা ভাবা যেতে পারে।