Economy of West Bengal

হাঁড়ির হাল?

এ মাসের গোড়ার দিকে মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের মুখ্যসচিবকে সঙ্গে নিয়ে সাংবাদিক বৈঠকে বসেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির ‘প্রকৃত অবস্থা’ আলোচনা করতে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৩ অগস্ট ২০২৩ ০৫:৩৭
Share:

—প্রতীকী ছবি।

কদর্য ব্যক্তিগত আক্রমণ, ‘তুই বেড়াল না মুই বেড়াল’-এর তরজা পেরিয়ে রাজ্য রাজনীতির তর্ক যদি অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে চলে, তাতে আপত্তি করার কোনও কারণ থাকতে পারে না। তবে, এই উত্তর-সত্য রাজনীতির যুগে অর্থনীতি বিষয়ক আলোচনার ক্ষেত্রেও সতর্ক থাকা জরুরি। বিশেষত, অর্থনীতি এমন একটি বিষয়, যা প্রত্যেক নাগরিকের জীবনে প্রভাব ফেলে, কিন্তু সেই তর্কের সত্যাসত্য যাচাই করার সামর্থ্য সব নাগরিকের সমান নয়। এ মাসের গোড়ার দিকে মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের মুখ্যসচিবকে সঙ্গে নিয়ে সাংবাদিক বৈঠকে বসেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির ‘প্রকৃত অবস্থা’ আলোচনা করতে। পশ্চিমবঙ্গে ঋণের ভারে কাবু, বিবেচনাহীন দাতব্যের পথে হেঁটে রাজ্যের অর্থনীতির হাঁড়ির হাল হয়েছে, এই কথাগুলি যে শুধুমাত্র বিরোধী দলের প্রচারেই শুনতে পাওয়া যায়, তা নয়— গত এক-দেড় বছরে কেন্দ্রীয় সরকার একাধিক বার এই কথা বলেছে, রাজ্যকে সতর্ক করে দিয়েছে। ফলে, অর্থনীতি-কেন্দ্রিক রাজনীতির ভাষ্যকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়োজন মুখ্যমন্ত্রীর হবে, তা বোঝা যায়। প্রশ্ন হল, রাজ্যের অর্থনীতির অবস্থা ঠিক কতখানি খারাপ? রাজ্যের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের নিরিখে যদি মাপতে হয়, তবে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান দেশের মধ্যে ছ’নম্বরে। মাথাপিছু উৎপাদনের প্রশ্নে খানিক পিছিয়ে, তবে বৃহৎ রাজ্যগুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান কখনও মাঝামাঝির চেয়ে খারাপ নয়। আর্থিক বৃদ্ধির হারও সাড়ে দশ শতাংশের কাছাকাছি। সুতরাং, পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির নাভিশ্বাস উঠছে, এমন দাবি যথেষ্ট বাস্তবসম্মত নয়।

Advertisement

যাঁরা রাজ্যের অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য বিষয়ে বিচলিত, তাঁদের মূল উদ্বেগ ঋণের পরিমাণ নিয়ে। ঋণের মোট বোঝা কতখানি, সে হিসাব বহুলাংশে অপ্রয়োজনীয়, ঋণ কতখানি বিপজ্জনক, তা নির্ভর করে ঋণ পরিশোধের সামর্থ্যের উপরে। পরিশোধের সামর্থ্যের নিরিখে ঋণের বোঝার ‘বিপদ’ বিচার করার মাপকাঠি হল রাজ্যের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের অনুপাত হিসাবে ঋণের পরিমাণটিকে দেখা। মুখ্যসচিব মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এই অনুপাতটি নিম্নমুখী। তৃণমূল কংগ্রেসের শাসনকালে এই রাজ্যে ঋণের বোঝা যতখানি বেড়েছে, তার চেয়ে বেশি অনুপাতে বেড়েছে রাজ্যের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন, এবং রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ। পশ্চিমবঙ্গ দেশের সবচেয়ে বেশি ঋণগ্রস্ত রাজ্যগুলির তালিকায় রয়েছে বটে, কিন্তু সেই ঋণ রাজ্যের সাধ্যাতীত, এমন দাবি করার কোনও কারণ নেই। বস্তুত, কোন রাজ্যের ঋণ কতখানি সাসটেনেব‌্‌ল বা সুস্থায়ী, সে বিষয়ে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক একটি সমীক্ষা করেছিল। এ রাজ্যের ঋণের উপরে প্রদত্ত সুদের হারের চেয়ে রাজ্যের আর্থিক বৃদ্ধির হার যে-হেতু সব সময়ই বেশি, ফলে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের সমীক্ষাও এই ঋণকে যথেষ্ট বিপজ্জনক বলে মনে করেনি। ফলে, রাজ্যের আর্থিক স্বাস্থ্য বিষয়ক যে ‘উদ্বেগ’ নিয়মিত শোনা যাচ্ছে, তার পিছনে অর্থনৈতিক যুক্তি যতখানি রয়েছে, তার চেয়ে রাজনৈতিক কারণই বেশি বলে অনুমান করা চলে।

তা হলে কি রাজ্যের আর্থিক পরিচালনা বিষয়ে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত থাকা চলে? একেবারেই নয়। রাজ্যের ঋণের বোঝা সাসটেনেব‌্‌ল হলেও অদূর ভবিষ্যতে এসজিডিপি-র অনুপাতে তা যে কমবে না, এই বাস্তবের পাশাপাশি আরও কিছু সমস্যা রয়েছে। ঋণের পরিমাণ বাড়ামাত্রই সমস্যার কারণ নয়— কিন্তু কোন কাজে সেই ঋণের টাকা ব্যবহৃত হচ্ছে, সে দিকে খেয়াল রাখা জরুরি। ঋণের টাকার সিংহভাগ যদি বেতন আর পেনশন দিতেই খরচ হয়ে যায়, তবে তা রাজ্য অর্থনীতির পরিচালনা সম্বন্ধে ইতিবাচক ইঙ্গিত বহন করে না। তবে, রাজ্যের মোট রাজস্ব আদায়ের কত শতাংশ বকেয়া ঋণের উপর সুদ মেটাতে খরচ হয়, সেই অনুপাতটি গত কয়েক বছর ধরে নিম্নমুখী। অর্থাৎ, ঋণ বাড়া সত্ত্বেও উন্নয়নখাতে খরচের মতো অর্থের পরিমাণও বাড়ছে। সে টাকা কী ভাবে খরচ হচ্ছে, সে দিকে নজর রাখার দায়িত্বটি বিরোধীরা নিতেই পারেন।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement