—প্রতীকী ছবি।
এক কালে বঙ্গবাসীর, বিশেষ করে শহরের অল্প বয়সিদের, মনে শারদোৎসবের প্রথম ঘণ্টা বাজত বিশ্বকর্মা পুজোর দিনে। স্কুলে যাওয়া-আসার পথে এক দিন ভাবী নাগরিকের চোখে পড়ত বিশ্বকর্মার জন্য মণ্ডপ বাঁধা হচ্ছে, তার পরে সেই মণ্ডপে তিনি আসতেন হাতির পিঠে চেপে, ভাদ্র-আশ্বিনের শারদপ্রাতে প্রথম ঢাক বেজে উঠত, তরুণ মনে তার প্রতিধ্বনি বাজত: পুজো আসছে। সে বড় আনন্দের লগ্ন। আজ আর সেই আনন্দের কোনও চিহ্নও নেই। কোনও দিক থেকেই নেই। দুর্গোৎসব এখন ঘোর বর্ষার কাল থেকেই বিপুল নিনাদে তার আসবার খবর জানাতে থাকে, সর্বব্যাপী বাজারের অগণন এবং অবিরত বিজ্ঞাপনী বার্তায় তার দিন গোনা চলতে থাকে, তাই আলাদা করে আগমনী সঙ্কেতের কোনও প্রয়োজন নেই, তেমন সঙ্কেত আবিষ্কার করে প্রাণে খুশির তুফান উঠবে, তারও জো নেই। অন্য দিকে, বিশ্বকর্মার প্রতিপত্তি এখন সম্পূর্ণ অন্তর্হিত বললে কিছুমাত্র অত্যুক্তি হয় না। জনপরিসরে তাঁর পুজো হয় বটে, কিন্তু শারদীয় উৎসবের অঙ্গ হিসাবে তার কোনও ভূমিকাই আজ আর অবশিষ্ট নেই, শহরের যত্রতত্র সারা বছর যে রকমারি মেলা খেলা ইত্যাদির আয়োজন চলতে থাকে, এটিও এখন তার সমগোত্রীয় এক ঘটনায় পরিণত।
এই পরিণতি আকস্মিক নয়। অনেক দিন ধরেই এই অবনমন জারি ছিল। এবং সেই প্রক্রিয়াটি নিছক একটি উৎসবের অবনমন নয়, তার গভীরতর সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণ আছে, যা পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনৈতিক কারণটি সহজবোধ্য। বিশ্বকর্মা দেবলোকের স্থপতি, নির্মাতা, যন্ত্রবিদ। তাঁর আরাধনা জড়িয়ে ছিল শিল্প-উৎপাদন এবং তার সংশ্লিষ্ট বাণিজ্যের সঙ্গে, এক কথায় শিল্পনির্ভর অর্থনীতির সঙ্গে। এক কালে বাংলা তথা পশ্চিমবঙ্গে শিল্পের সুদিন ছিল, বিশ্বকর্মা পুজোর মর্যাদাও ছিল তার অনুসারী। গত শতাব্দীর মধ্যপর্ব থেকেই রাজ্য অর্থনীতির ক্ষয় ত্বরান্বিত হয়, শিল্প-উদ্যোগে ভাটার টান প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে ওঠে। বিশেষ করে যে ছোট এবং মাঝারি শিল্পসংস্থাগুলি এক সময় এই রাজ্যের অর্থনীতির এক বড় সম্পদ ছিল, তাদের জরা, ব্যাধি এবং মৃত্যুর ধারাবাহিক ইতিবৃত্ত রচিত হতে থাকে। লক্ষণীয়, শহরে এবং মফস্সলে এই ধরনের বহু সংস্থাতেই যন্ত্রদেব বিশ্বকর্মার আরাধনা হত। তাঁর সামাজিক প্রতিপত্তি খর্ব হওয়ার কাহিনিতে তাই নিহিত আছে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক অবক্ষয়ের করুণ ইতিহাস।
সেই ইতিহাসে বঙ্গসমাজের এক দুর্ভাগ্যজনক মানসিকতার ভূমিকাও অস্বীকার করা চলে না। এই সমাজের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে শিল্পবাণিজ্যের প্রতি এক গভীর উপেক্ষা, বিরাগ, এমনকি বিরূপতার ঐতিহ্য দীর্ঘকাল ধরেই চলে আসছে। সংস্কৃতির ভুবনে যে মধ্যবিত্ত নাগরিকের ঐতিহাসিক আধিপত্য, যাকে এক কথায় ভদ্রলোকের কালচার বলে অভিহিত করা চলে, তার কাছে কলকারখানা এবং ব্যবসাবাণিজ্য কোনও দিনই মর্যাদা পায়নি। প্রথমত, মানসবৃত্তির অনুশীলনকে কায়িক শ্রমের তুলনায় উচ্চতর বলে মনে করার প্রবণতা এবং দ্বিতীয়ত, মানসিক শ্রমের পরিসরেও শিল্পবাণিজ্যের উপযোগী হিসাবনিকাশ বা প্রযুক্তির চর্চাকে ‘সূক্ষ্মতর’ বা ‘গভীরতর’ মানবিকী বিদ্যার তুলনায় নীচে রাখার ঐতিহ্য— এই দু’টি স্তরেই বাঙালি ভদ্রলোকের সংস্কৃতি নিজের স্বাতন্ত্র্য নিয়ে গর্বিত বোধ করেছে। এই স্বাতন্ত্র্য এক ধরনের সঙ্কীর্ণতার সূচক। বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মতো ব্যতিক্রমী চিন্তকরা এই সঙ্কীর্ণতা নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়েছেন, তিরস্কার করেছেন, কিন্তু তাঁরা ব্যতিক্রমীই থেকে গিয়েছেন। এটা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার যে, বঙ্গীয় নাগরিক সমাজ এই রাজ্যের ‘সাংস্কৃতিক অবক্ষয়’ নিয়ে যে পরিমাণ উদ্বেগ প্রকাশ করে এসেছেন, ‘অপসংস্কৃতি’র উপদ্রব নিয়ে তাঁরা যতটা ভাবিত, শিল্প-প্রযুক্তি এবং ব্যবসায়িক সামর্থ্যের ক্রমিক ও শোচনীয় ক্ষয়ের দীর্ঘ ইতিহাস নিয়ে সেই তুলনায় তাঁদের আদৌ মাথাব্যথা নেই। একটি দৃষ্টান্ত হিসাবে বলা যায়, বিশ্রুত ভাস্কর মীরা মুখোপাধ্যায়ের গবেষণাঋদ্ধ গ্রন্থ বিশ্বকর্মার সন্ধানে নাগরিক বাঙালির উদাসীন মনে কতটুকু সাড়া জাগাতে পেরেছে? স্থানীয় বা আঞ্চলিক অর্থনীতির দুর্বলতা শেষ অবধি সংস্কৃতির ভুবনে প্রভাব ফেলতে বাধ্য— বঙ্গসমাজে ভদ্রলোকের কালচার দ্রুত তার আধিপত্য হারাচ্ছে। কিন্তু মানসিকতা বস্তুটি নিতান্তই দুর্মর, বিশেষত সংস্কৃতির অভিমান যখন পরাজিতের শেষ সম্বল হয়ে দাঁড়ায়— সত্যজিৎ রায়ের জলসাঘর স্মরণীয়। বিশ্বকর্মার দুর্দশা এই মানসিকতার প্রতীকও বটে, পরিণামও বটে।