এক কালে বেশির ভাগ অস্ত্রই রাজ্যে ঢুকত প্রতিবেশী রাজ্য থেকে। —ফাইল চিত্র।
পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচন ফের গোটা দেশের নজর কাড়তে সক্ষম হল— এমন হিংসাবহুল নির্বাচন এখন ভারতের আর কোনও প্রান্তে অনুষ্ঠিত হয় না। রাজ্যে নির্বাচন চলছিল, না কি যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি, অস্ত্রের বহর দেখে তা বোঝা মুশকিল। এত অস্ত্র কেন, সেই প্রশ্নটি পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ঘোলা জলে পাক খেতেই থাকে, উত্তর আর মেলে না। বগটুই কাণ্ডের পরই মুখ্যমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছিলেন, রাজ্যে যেখানে যত বেআইনি অস্ত্র মজুত আছে, সব বাজেয়াপ্ত করতে হবে। সেই নির্দেশ দৃশ্যত পালন করা হয়নি। কেউ অবাক হয়ে প্রশ্ন করতে পারেন, রাজ্যের সর্বময় কর্ত্রীর নির্দেশ অগ্রাহ্য করার মতো সাহস পুলিশ-প্রশাসনের আদৌ থাকতে পারে কি? সে ক্ষেত্রে একাধিক সম্ভাবনা রয়েছে— এক, মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের উপর দিয়ে যেতে পারে, এমন কোনও রাজনৈতিক ক্ষমতাকেন্দ্র রাজ্যে তৈরি হয়েছে; দুই, স্থানীয় স্তরের নেতাদের উপরে মুখ্যমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়েছে, এবং পুলিশ স্থানীয় নেতাদের চটাতে নারাজ; তিন, অস্ত্র উদ্ধার করার সামর্থ্য রাজ্য পুলিশের নেই; এবং চার, বেআইনি অস্ত্র উদ্ধারের যে ‘নির্দেশ’ মুখ্যমন্ত্রী দিয়েছিলেন, তাতে দুধ ও জলের অনুপাত পুলিশ-প্রশাসন জানে। কোন সম্ভাবনাটি সত্য, অথবা একই সঙ্গে একাধিক সম্ভাবনা সত্য কি না, সেই জল্পনা অপ্রয়োজনীয়। মোট কথা হল, নির্বাচনে এমন রক্তক্ষয় এড়ানোর কোনও উপায় এই রাজ্যের প্রশাসন করে উঠতে পারেনি। সেই লজ্জা রাজ্য প্রশাসনকে বহন করতে হবে— প্রশাসনিক প্রধান হিসাবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও কোনও মতেই সেই দায় এড়াতে পারেন না।
এক কালে বেশির ভাগ অস্ত্রই রাজ্যে ঢুকত প্রতিবেশী রাজ্য থেকে। সংবাদে প্রকাশ, বাংলা এখন অস্ত্রে স্বনির্ভর হয়েছে— বোমা তো বটেই, দেশি বন্দুক তৈরিও ক্রমে রাজ্যব্যাপী কুটির শিল্পে পরিণত হয়েছে। পুলিশমহলের বক্তব্য, কোথায় কার ঘরে অস্ত্র তৈরি হচ্ছে, সে খবর পাওয়ার মতো নেটওয়ার্ক রাজ্য পুলিশের আর নেই, ফলে তা ঠেকানোর পথও নেই। পুলিশের নেটওয়ার্কের অবস্থা এমন করুণ কেন, সেই প্রশ্নটি করা প্রয়োজন। কিন্তু, তারও আগে প্রশ্ন— অস্ত্র যদি বা ঘরে তৈরি হয়, তার কাঁচামাল তো আর ঘরে উৎপন্ন হয় না। বোমা বা বন্দুক তৈরির উপাদান সংগ্রহ করতে হয় বাইরে থেকেই। কোন অঞ্চলে তেমন জিনিসের লেনদেন বেড়েছে, সেই খোঁজটুকুও যদি পুলিশের কাছে না থাকে, তা হলে চলে কী করে? অনুমান করা চলে, এই সব খোঁজখবর রাখায় এখন আর তেমন নম্বর নেই— বরং, ক্ষেত্রবিশেষে উদাসীন থাকতে পারলেই মঙ্গল।
রাজ্য রাজনীতিতে অস্ত্র আর ব্যতিক্রম নয়, তা রাজনৈতিক মূল কাঠামোর অঙ্গ। তা কেবল পাইকারি হারে অস্ত্রের ব্যবহারের কারণেই নয়— বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতি অস্ত্র দ্বারা পরিচালিত। এই রাজনীতিতে জনাদেশ তার গুরুত্ব হারিয়েছে। মানুষ কী চায়, কোনও পক্ষেরই আর তা জানার আগ্রহ নেই— জনাদেশকে অস্ত্রের জোরে প্রভাবিত করা, অথবা সেই বালাইটুকুও ছেঁটে ফেলে অস্ত্র দিয়েই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ফলাফল নির্ধারণ করে নেওয়া এখন রাজ্য রাজনীতির দস্তুর। তার সিংহভাগ দায় শাসক দলের, কিন্তু বিরোধীরাও যে নিষ্কলুষ নন, নির্বাচনী হিংসা তার সাক্ষ্য বহন করে। রাজ্য প্রশাসনের কর্তব্য ছিল অস্ত্রের এই রমরমাকে নিয়ন্ত্রণ করা। কিন্তু, সেটুকুই যথেষ্ট নয়। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিকে এই হিংসার স্রোতের বাইরে আনতে চাইলে প্রথমে গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধার প্রাথমিক পাঠটি সব দলকে গ্রহণ করতে হবে, দলের নিচুতলা অবধি সেই শিক্ষা পৌঁছে দিতে হবে। অস্ত্রই ক্ষমতার উৎস, এই বিশ্বাসের মূলোচ্ছেদ না করতে পারা অবধি হিংসা চলতেই থাকবে। প্রশ্ন হল, এই হিংসার রাজনীতির ‘সুফল’ পরিত্যাগ করে গণতন্ত্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করার মতো মনের জোর রাজনৈতিক দলগুলির আছে কি?