—প্রতীকী ছবি।
পঞ্চায়েত বোর্ড গঠন পর্বেও হিংসার স্রোত বইল পশ্চিমবঙ্গে, যা চূড়া স্পর্শ করল দশটি গুলিতে তৃণমূলের এক বিজয়ী প্রার্থীর হত্যায়। লক্ষণীয়, সেই গ্রাম পঞ্চায়েতে (উত্তর ২৪ পরগনার হাড়োয়া ১ ব্লকের খাসবান্দা) নিরঙ্কুশ জয়ী হয়েছিল তৃণমূল। তার পরেও প্রাণ হারাতে হল শাসক দলের কিসান খেতমজুর সেল-এর সভাপতিকে। মৃতের স্ত্রী দলের দিকে আঙুল তুলেছেন, তৃণমূল নেতারা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। ওই হত্যা তদন্তাধীন, কিন্তু বোর্ড গঠন পর্বে জয়ী প্রার্থীদের উপর আক্রমণ, অপহরণ, বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ঘটেছে সারা রাজ্যে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। ভোটগণনা পর্ব এবং বোর্ড গঠন পর্বে বিশৃঙ্খলা, আইনভঙ্গ এবং হিংসার যে সব দৃশ্য দেখা গেল এ বছর, তা ভীতিপ্রদ। সদস্যরা জয়ী ঘোষিত হওয়ার পরেও ঐকমত্যের ভিত্তিতে, অথবা ভোটাভুটির মাধ্যমে বোর্ড গঠন করতে যদি না পারেন, যদি বন্দুকের নল বা বোমার জোরেই ফয়সালা করতে হয়, দলবদলে বাধ্য করতে যদি মহিলা-সহ জয়ী প্রার্থীদের অপহরণ করে বন্দি করা হয়, মিথ্যা মামলায় জেলবন্দি করতে হয় বিরোধী বা বিক্ষুব্ধদের, তা হলে নির্বাচনের প্রহসনটির আর কোনও প্রয়োজনীয়তা অবশিষ্ট থাকে কি? এই সদস্যরা একটি সুষ্ঠু প্রশাসন চালাবেন, উন্নয়নের প্রকল্পের রূপায়ণ করবেন পরস্পর আলোচনা এবং ঐকমত্যের ভিত্তিতে, বোর্ড গঠনের প্রক্রিয়া দেখার পরে এমন আশা করার সাহস কারই বা থাকতে পারে?
এক সময়ে উদ্বেগ দেখা গিয়েছিল, রাজনীতিতে দুষ্কৃতীদের আধিপত্য বাড়ছে, রাজনীতির ‘অপরাধায়ন’ ঘটছে। পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েতের বোর্ড গঠন পর্ব দেখে মনে হয়, আজ রাজনীতির চৌহদ্দিতে পা রাখলে দুষ্কৃতী না হয়ে যেন উপায় নেই। নির্বাচনের মতোই বোর্ড গঠনেও হিংসার একটা সংগঠিত চেহারা প্রকট হয়েছে। রাশি রাশি বোমা উদ্ধার (কেবল রায়দিঘি থেকেই একত্রে সত্তরটি), পঞ্চায়েত দফতরে ও গ্রামের ভিতরে বোমাবাজি, পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর, বাইক পোড়ানো, বহিরাগতদের নিয়ে তাণ্ডব, বাইকবাহিনীর দাপট, পুলিশের ব্যারিকেড ভাঙা, এবং বিপরীতে পুলিশের লাঠিচার্জ, র্যাফ, ১৪৪ ধারা জারি— পরিচিত ছকে ঘটল সবটা। কেবল ভাঙড়ের মতো রাজনৈতিক উত্তেজনাপ্রবণ এলাকা নয়, হুগলির খানাকুল, হাওড়ার জগৎবল্লভপুর, পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দকুমার ও ঘাটাল, মালদহের চাঁচল ও গাজল, কোচবিহারের দিনহাটা, জলপাইগুড়ির খড়িয়া ও ওদলাবাড়ি, বীরভূমের খয়রাশোলের পাঁচড়া, মুর্শিদাবাদের বড়ঞা, দক্ষিণ ২৪ পরগনার বারুইপুরের বেগমপুর, এমন আরও কত এলাকায় প্রকাশ্য হিংসার দৃশ্য দেখা গিয়েছে টিভির পর্দায়। বলা বাহুল্য, যে সব জায়গায় নীরব সন্ত্রাস চলেছে, অর্থাৎ কেবল ভীতিপ্রদর্শনেই হার মেনেছে এক পক্ষ— সেখানকার কথা আসেনি সংবাদে। এলে, সামগ্রিক ছবিটি ভয়ঙ্করতর হত।
হিংসায় অভিযুক্ত সব দলের নেতাকর্মীরাই, তবু শাসক দলের জন্য একটি বিশেষ রাজনৈতিক বার্তা যেন বহন করল এই নির্বাচন-পরবর্তী পর্বটি। বোর্ড গঠনে শান্তি রাখতে দলকে নির্দেশ দিয়েছিলেন শীর্ষনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার আগে ‘নবজোয়ার’ যাত্রা করে সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় দলের সদস্যদের মনোনীত ব্যক্তিকে প্রার্থী করার আশ্বাস দিয়েছিলেন। কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, হিংসায় প্রাণ হারালেন শাসক দলের বহু নেতা-কর্মী, নিরঙ্কুশ জয়ী পঞ্চায়েতেও প্রধান; উপপ্রধান পদের জন্য দলের সদস্যদের মধ্যে সংঘাত নামল রাস্তায়; দলের মধ্যে গোষ্ঠী-সংঘাত কার্যত বিরোধীর সঙ্গে সংঘাতের মতোই ভয়ানক ও নিষ্করুণ হয়ে উঠল। তা হলে কি বুঝে নিতে হবে যে, ক্ষমতা দখলের লড়াইকে সংযত করতে পারে, দলের শীর্ষ নেতৃত্বেরও আর সেই কর্তৃত্ব নেই। হিংসা-নির্ভরতার এই বিষফল অবশ্যম্ভাবী। বাঘের পিঠে সওয়ার হওয়ার ফল কী হয়, বোর্ড গঠন পর্ব তা দেখিয়ে দিয়ে গেল রাজ্যের শাসক দলকে।