পুলিশকে মারধরের এই ছবি এখন ভাইরাল। যদিও ভিডিয়োর সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার অনলাইন। ছবি: সংগৃহীত।
দিনাজপুরের ছবিটি পশ্চিমবঙ্গের যে পরিচয় দিচ্ছে, তা উদ্বেগের, আতঙ্কেরও। এই রাজ্যে আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি এখন রাজ্যবাসীকে প্রবল অসহায়তা-সাগরে নিমজ্জিত করার মতোই ভীতিজনক। ঘরের কোণে লুকিয়ে থাকা পুলিশের ভয়ার্ত চেহারা দেখে রাজ্যবাসী বিস্মিত হয়ে ভাবছেন, এই সেই বাহিনী, যাঁদের উপর তাঁরা নিজেদের নিরাপত্তা সঁপে দেন, শেষ ভরসা বলে যাঁদের আশ্রয় ও আশ্বাসের প্রত্যাশা করেন। উত্তর দিনাজপুরে যে ভাবে পুলিশের উপর মানুষ চড়াও হলেন, আগে মহানগরী কলকাতার বুকেও ঠিক একই চিত্র দেখা গিয়েছে। কেবল কালিয়াগঞ্জ থানা আক্রমণ নয়, ঘটনার সূচনায় নিতান্ত অমানবিক ভাবে মেয়েটির দেহ উদ্ধাররত পুলিশের দিকেও লক্ষ করে ধেয়ে এসেছিল প্রস্তরখণ্ডসমূহ। পুলিশের বিশ্বাসযোগ্যতা কোথায় এসে ঠেকলে রাজধানী থেকে রাজ্যের প্রত্যন্তে সর্বত্র বারংবার তাঁদের দিকে আক্রমণ ধাবিত হয়, টেবিলের তলায় বা গৃহকোণে তাঁদের আশ্রয় নিতে হয়— বুঝতে অসুবিধা নেই।
উত্তর দিনাজপুরের মর্মন্তুদ ঘটনার পর থেকে যা যা ঘটছে, তা যেন ঘটনার ভয়াবহতাকেই ছাপিয়ে যাওয়ার জোগাড়। পুলিশকর্মীরা নিজেরাই বিচলিত হয়ে পড়েছেন পরিস্থিতি দেখে, কেউ কেউ এমনও বলেছেন যে, তাঁদেরও তো সন্তান আছে, তাঁদের নিরাপত্তার কথাই বা কে ভাবে! পুলিশের আবাসনে তাঁদের পরিবার বিপন্ন হয়ে পড়ছেন, শোনা গিয়েছে। অর্থাৎ পুলিশকর্মীদের পরিস্থিতিটিও দৃশ্যত একই রকমের উদ্বেগজনক। ব্যক্তিগত ভাবে তাঁরা দুর্জন নন, অনেকেই হয়তো সাধারণ নাগরিকের মতো একই রকমের অসহায় সন্তান, পিতা, স্বামী কিংবা অভিভাবক— কিন্তু আজ তাঁরা এমন জায়গায় নিক্ষিপ্ত যে, ব্যক্তিগত জীবন দিয়েই প্রশাসনের অকর্মণ্যতার দাম মেটাতে হচ্ছে তাঁদের একাংশকে। ঘটনা এবং ঘটনার পরবর্তী ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সব খতিয়ে দেখে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যখন রাজনৈতিক উস্কানি ইত্যাকার ব্যাখ্যা দেবেন, তখন যেন তিনি মনে রাখেন যে, এমন পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গবাসীকে নিয়ে আসার মূল দায়িত্বটি কিন্তু— শাসক হিসাবে— তাঁকে এবং তাঁদেরই নিতে হবে। দুষ্কৃতীদের আটকানোর কথা ছিল যাঁদের, সেই নিরাপত্তা বাহিনী তাঁদের শাসনে ক্রমাগত অকেজো হয়ে পড়েছে, দলশৃঙ্খল-নিরপেক্ষ শাসনপ্রণালী বহুলাংশে বিলুপ্ত হয়েছে। এই ধারাটি পশ্চিমবঙ্গে নতুন নয়, তৃণমূল-পূর্ব সময়েও তার বহু নিদর্শন ছিল। কিন্তু প্রাচীন কাসুন্দি দিয়ে বর্তমানের অজুহাত চলে না। বর্তমান সরকারের আমলে যে ভাবে শীর্ষ নেতৃত্বের নিরন্তর অনুমোদনে রাজ্যের নিম্ন প্রশাসনকে দ্রুত দুর্বল করে দেওয়া হয়েছে, তার থেকেই আজ উৎসারিত দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ও অকর্মণ্যতার এই একাদিক্রম ছবি। সাধারণ্যের কাছে প্রশাসনের সবচেয়ে নিকট ও প্রত্যক্ষ প্রতিনিধি পুলিশ— সুতরাং নিচু স্তরের পুলিশকর্মীরাই এই ভাবে প্রহৃত হয়ে, ভয়ার্ত হয়ে রাজ্যের সার্বিক অপশাসনের মূল্য চোকাচ্ছেন।
পরিস্থিতির সুযোগ নিতে স্বার্থান্ধ রাজনীতি উদ্গ্রীব হবেই। প্রতিবেশী রাজ্য থেকে দুষ্কৃতী এনে থানায় চড়াও হওয়ার অভিযোগ যদি কিয়দংশেও সত্য হয়, তবে বিরোধী রাজনৈতিক দলের যোগসাযুজ্যের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া অসম্ভব। দুর্ভাগ্যের ভারা এই ভাবেই আজ পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে পূর্ণ হচ্ছে। উত্তরবঙ্গে ভোট-অর্জনে মরিয়া বিরোধী দল সমাজকে আরও বিষায়িত করবে, ধরে নেওয়া যায়। এমতাবস্থায় রাজ্য প্রশাসনের যদি এখনও নিজের অপহৃত সম্মান উদ্ধার করার শক্তি বা বাসনা থাকে, তবে সত্বর সমগ্র এলাকায় শান্তি ফেরানো হোক, অপরাধীদের শনাক্ত করে শাস্তি দান করা হোক, এবং পুলিশের মনোবল ফেরানোর জন্য যা যা করণীয়, দ্রুত সে বিষয়ে পদক্ষেপ করা হোক। সমগ্র ঘটনার মধ্যে কেবল উত্তর দিনাজপুরের সীমিত বাস্তবকে না দেখে রাজ্যের সার্বিক পরিস্থিতির প্রতীক হিসাবে ঘটনার বিবেচনা হোক। রাজ্যবাসী এই নৈরাজ্যের অবসান দাবি করছেন, এখনই।